বছর খানেক আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন তিনি। —প্রতীকী চিত্র।
তাঁদের মেয়েকে নাকি ভূতে পেয়েছে। সে ভূত কখনও মেয়েকে প্রবল আক্রমণাত্মক করে তোলে। আবার কখনও ভূতের জন্য মেয়ে শারীরিক ভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এক বছর ধরে ওঝা, গুণিন, কবিরাজ দেখিয়েছেন। কিছুতেই কিছু হয় না। কিন্তু ডাক্তার দেখান না কেন? মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ কীর্তন শিল্পী বাবার। বলেন, ‘‘বড় চিকিৎসক দেখানোর মতো সামর্থ্যও নেই আমাদের। মেয়েকে বাঁচাই কী করে?’’
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর শহরের ১৬ নম্বর তন্ময়পল্লির বাসিন্দা ওই তরুণী কলেজে পড়েন। অসুস্থতার জন্য দীর্ঘ দিন অবশ্য পড়াশোনা বন্ধ। ঘটনার সূত্রপাত আজ থেকে বছর খানেক আগে। পরিবার সূত্রে খবর, বছর খানেক আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন তিনি। মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান কিশোরীর বাবা ও মা। পরিবারের দাবি, ‘‘প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, শরীরে কোনও সমস্যা নেই। এর পরও মেয়ের অস্বাভাবিক আচরণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।’’ তাতেই পরিবারের লোকজন দ্বারস্থ হন ওঝা-গুণিনদের। চলে ঝাড়ফুঁক, তুকতাক। কিন্তু সময় যত যায়, ততই মেয়ের অস্বাভাবিক আচরণ বাড়তে থাকে। এখন খাওয়া-দাওয়া একপ্রকার ছেড়ে দিয়েছেন ওই তরুণী। সারা দিন বাড়িতে একটি মাদুরের উপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকেন তিনি। এক বার করে ঘোর কাটলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। তখন পরিবারের লোকজনকে মারধর করেন। হাতের কাছে যা পান ভেঙে চুরমার করে দেন। প্রতিবেশী এবং পরিবারের লোকজনের বলছেন মেয়েকে ভূতে পেয়েছে। তরুণীর বাবার দাবি, ‘‘মেয়ের শরীরে ভর করা ভূত ছাড়াতে শুধু স্থানীয় ওঝা-গুণিন নয়, মুর্শিদাবাদেও ছুটে গিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এক ওঝা জানিয়েছেন, মেয়ের শরীরে ভর করে আছে ভূত। তাকে বার করতে হলে তাড়াহুড়ো চলবে না। তিন মাস সময় নিয়ে সেই ভূতকে তাড়াতে হবে। তাড়াহুড়ো করলেই মেয়ের সর্বনাশ হবে।’’ কিশোরীর মা বলেন, ‘‘ভাল চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। বাধ্য হয়ে ওঝা গুণিনেই ভরসা রাখতে হয়েছে। জানি না আমার মেয়ে আর সুস্থ স্বাভাবিক হবে কি না।’’
এর মধ্যে রবিবার ওই তরুণীর বাড়িতে গিয়ে তার অস্বাভাবিক আচরণের ভিডিয়ো করেন এক ইউ টিউবার। তাতে দেখা যায় এক ওঝা কিশোরীকে ঝাড়ফুঁক করছেন। সেই ভিডিয়ো এখন ভাইরাল। ভিডিয়োটি দেখে বেশিরভাগ মানুষ মধ্যযুগীয় কুসংস্কার দূর করে কিশোরীর উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে দাবি করেছেন। বিজ্ঞানকর্মীরা বলছেন, ‘‘ভূত বা জিন বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। ওই তরুণী মানসিক রোগের শিকার। ওঝা-গুণিনে ভরসা না রেখে চিকিৎসা করালেই সুস্থ হতে পারেন তিনি।’’ বিষয়টি নজরে পড়েছে বিষ্ণুপুর পুরসভা এবং ব্লক প্রশাসনের। পুরসভার তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সোমবার তরণীর বাড়িতে যান ব্লক প্রশাসন, স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিক এবং বিজ্ঞান কর্মীরা।
ভারতীয় বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সৌম্য সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘ভূতে পাওয়া কাল্পনিক। কিছু আচরণকে ওই কিশোরী নকল করছেন। আমাদের ধারণা, আধুনিক চিকিৎসা করানো হলে ওই কিশোরী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।’’
এ নিয়ে বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান গৌতম গোস্বামী বলেন, ‘‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। প্রশাসনের তরফে আধিকারিকরা ওই কিশোরীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমরাও বিষয়টি আলোচনা করেছি। দ্রুত ওই কিশোরীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।’’