রাজনগরে বাহা পরবের আয়োজন। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
‘বাহা’ অর্থাৎ ফুল। শীতঘুম শেষে বসন্তের ছোঁয়া জেগে উঠে প্রকৃতি। শুধু পলাশ শিমূল নয়, ফুলে, পাতায় ভরে যায় নিম, শাল মহুয়া। প্রকৃতির নতুন রূপে সেজে ওঠাকে সাক্ষী রেখে মঙ্গলবার রাজনগরের বাগদিপাড়া বাগানপাড়ায় সাড়ম্বরে পালিত হল আদিবাসীদের বসন্তকালীন উৎসব ‘বাহা পরব’। ওই আদিবাসী গ্রাম ও আশপাশের আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দারা তো বটেই, অনুষ্ঠান সফল করতে এগিয়ে এলেন পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীরাও।
এ দিন সকালেই গ্রামের মহিলা ও পুরুষ নাচ-গান করতে করতে আদিবাসী পুরোহিত নাইকে-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের দেবী জাহেরা-র থানে আসেন। পালিত হয় নানা ধর্মীয় আচার। তার পরে দেবীর প্রসাদ খেয়ে ফের শুরু হয় নাচগান। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। শাল, পলাশ, মহুয়া ঘেরা জঙ্গলের মাঝে একটি অংশকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল সে জন্য। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল লেখক শিল্পী সঙ্ঘ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নিজেদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির শিকড়ের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে ১৩ সালে ওই গ্রামে বাহা পরব শুরু করেছিলেন প্রয়াত শিল্পী তথা বাসিন্দা দেবীশ্বর পাঁউরিয়া। যিনি রাজনগর পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সহ-সভাপতিও ছিলেন। আদিবাসী লেখক শিল্পী সঙ্ঘের রাজ্য কমিটির সদস্য শীতল বাউড়ি বলেন, ‘‘দেবীশ্বরদা উদ্যোগী হয়েছিলেন কারণ, দঙ, লাগড়ে, দাঁশাইয়ে নাচগানের চর্চা থাকলেও ধীরে ধীরে ফুলের উৎসব বাহা কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছিল। এখন সেই বাহা পরব সাবলম্বী হয়ে উঠেছে।’’
স্থানীয় বাসিন্দা কালো পাঁউড়িয়া বলেন, ‘‘এই বাহা পরব আমাদের কাছে খুবই পবিত্র ও প্রাচীন একটি উৎসব। নির্দিষ্ট কোনও দিনক্ষণ নেই বাহা পরবের। আসলে শাল গাছে যখন ফুল আসে, তখনই পরব হয় সকলের মিলিত সিদ্ধান্তে। তার আগে পর্যন্ত আদিবাসীরা কেউ নতুন পাতায় খান না, আদিবাসী মহিলারা খোঁপায় ফুল গোঁজেন না। দেবীকে প্রসন্ন করে আর্শীবাদ চাওয়া হল, যাতে এ বার বৃষ্টি ভাল হয়, সমগ্র জীবকূলের ভাল হোক এবং ফসল হোক।’’
স্থানীয় আদিবাসী গ্রামগুলি থেকে ১০, ১২টি নাচের দল ছিলই। ঝাড়খণ্ডের কুকুর থোপা গ্রামের একটি আদিবাসী দলকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল বাহা-র নাচ ও গান রীতি মেনে করার জন্য। উৎসব দেখতে ভিড় জমালেন আশপাশের সুন্দরখেলে, রাজারকেন্দ, হীরাপুর, গুরুজনডিহি-সহ বেশ কয়েকটি আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দারা। নাচগানের মজা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা পেটভরে খেলেন জাহেরা-র প্রসাদ। মনসা মুর্মু, বাহামতি মুর্মু, রশমী টুডু, ললিতা টুডুরা বলেন, ‘‘দারুণ কাটল একটা দিন। নাইকে বিশ্বেশ্বর পাঁউড়িয়া জানালেন, আচার অনুষ্ঠানের শেষে গ্রামে ফিরে জল গিয়ে হোলি খেলা হবে।’’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা পরিবেশ কর্মী তথা গবেষক রুটেন্ড এনগেরা। তিনি বলেন, ‘‘আদিবাসী জনজাতি সংস্কৃতি ও অতীতের সঙ্গে বিজ্ঞান, প্রযুক্তির যোগসূত্র খুঁজে বের করাই আমার কাজের বিষয়বস্তু।। গত দু’মাস ভারতে ঘুরছি। আজ এখানে এসে মাদলের বোল আমাকে যেন ঘরের কথা মনে করিয়ে দিল।’’