পড়ুয়াদের সঙ্গে শিক্ষক রিপনকান্তি বালা। —নিজস্ব চিত্র।
কথায় কথায় আমরা এক পলক, এক নিমেষ, কিছুক্ষণের মতো সময়জ্ঞাপক বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে থাকি। অনেকে এই শব্দগুলির মানে জানেন না। লাভপুরের শীতলগ্রাম প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এক পলকেই বলে দিতে পারে ওই সব শব্দের মানে। কতগুলি ক্ষণ নিয়ে এক নিমিষ হয় বা এক দণ্ডে কতগুলি ক্ষণ লাগে তাও কণ্ঠস্থ তাদের। বানানগুলির নির্ভুল ব্যবহারও তাদের কাছে সহজসাধ্য হয়ে গিয়েছে। তাদের এই বুৎপত্তির মূলে রয়েছে ওই স্কুলেরই সহকারী শিক্ষক বছর পঁয়ত্রিশের রিপনকান্তি বালা।
শিক্ষা দফতর এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৮০। শিক্ষক, শিক্ষিকা রয়েছেন চার জন। প্রত্যন্ত এলাকার ওই স্কুলটি এক সময়ে জেলার আর পাঁচটা পিছয়ে পড়া স্কুলের থেকে আলাদা ছিল না। ছাত্র-ছাত্রীদের কামাই, স্কুলছুট লেগেই ছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, রিপন যোগ দেওয়ার পরে থেকে সেই চিত্রটা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে।
রিপনের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার রুদ্রপুর গ্রামে। ২০২১ সালে তিনি ওই স্কুলে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মানোন্নয়নের উপরে জোর দেন। খেলার ছলে পড়া বা পড়ার ছলে খেলায় পড়ুয়াদের উৎসাহী করে তোলেন। সবার আগে বন্ধুর মতো মেলামেশা শুরু করেন। তাদের সঙ্গে খেলতে শুরু করেন। সঙ্গে চলে পাঠদান। কখনও শব্দকোষর নানা শব্দ চয়ন করে পড়ুয়াদের রপ্ত করাচ্ছেন। কখনও কবিতাকে আত্মস্থ করার জন্য গান বা গল্পের আকারে পড়াছেন। বৃত্ত বিভাজন করে বোঝাচ্ছেন কৌণিক পরিবর্তন। সব মিলিয়ে লেখাপড়ার ধরনই বদলে দিয়েছেন।
এতে ফলও মিলেছে। শুভজিৎ বাগদি এক সময় স্কুলেই আসতেই চাইত না। ক্রিকেট খেলে বেড়াত। তাকে স্কুলমুখী করতে কেনা হয় ব্যাট-বল। ব্যাটবলের টানে স্কুলে হাজিরা বাড়িয়ে সেই শুভজিৎই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির সীমা দাসের কাছে স্কুলটা ছিল জেলখানা। এখন স্কুলটাই তার কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
চতুর্থ শ্রেণির আর্য দাস, রিক দাস, পম্পা রায়রা বলে, ‘‘আগে আমাদের স্কুলে আসতে ভাল লাগত না। এখন ছুটি থাকলে বাড়িতে মন টেকে না। স্যরের কাছে সহজ ভাবে কত নতুন নতুন জিনিস শিখতে পারি।’’ অভিভাবক প্রকাশ দাস, সুমন্ত ঘোষ, শতাব্দী দাসেরা বলেন, ‘‘আগে ছেলে-মেয়েদের মেরেধরে স্কুলে পাঠাতে হত। এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য তর সয় না। ওরা এমন সব শব্দের মানে জানে যা আমরাও জানি না।’’
শুধু অভিভাবকেরাই নন, ওই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা পায়েল মণ্ডলও বলেন, ‘‘অস্বীকার করব না রিপনবাবু ছাত্র-ছাত্রীদের সেসব শব্দের অর্থ শিখিয়েছেন তার মানে আমরাও জানতাম না। তাঁর ভিন্ন ধারার পাঠদানের জন্য ৪০ শতাংশ থেকে ৯৯ শতাংশ হাজিরা বেড়েছে। স্কুলছুট নেই বললেই চলে। পঞ্চম শ্রেণিতে চলে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরাও স্কুলের টান ভুলতে পারে নি। মাঝেমধ্যে এসে হাজির হয়। ওই শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতি আমরাও অনুসরণ করছি।’’
শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালিখি করেন রিপন। তিনি বলেন, ‘‘জানা এবং জানানোর আগ্রহ থেকেই আমি নানা শব্দের মানে আয়ত্তে আনি। শিক্ষাটা যাতে পড়ুয়াদের কাছে নীরস ব্যাপার হয়ে না দাঁড়ায় তার জন্য নতুন নতুন ভাবনা করি।’’
সংশ্লিষ্ট লাভপুর দক্ষিণ চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক সব্যসাচী ঘোষ বলেন, ‘‘ওই শিক্ষকের জন্য শীতলগ্রামের স্কুলটি উন্নয়নের নিরিখে পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। তাঁর ব্যতিক্রম শিক্ষাদান পদ্ধতি অন্য স্কুলগুলিকে অনুপ্রাণিত করবে।’’