Redbank Tea Garden

‘করে দেব’ আশ্বাস, তবু দরজা খোলে না

গত লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ময়নাগুড়ির মাঠে এসে ঘোষণা করেছিলেন, জলপাইগুড়ির সব বন্ধ বাগান খুলেদিয়েছে কেন্দ্র, তখনও রেডব্যাঙ্ক বন্ধই ছিল।

Advertisement

অনির্বাণ রায় , পার্থ চক্রবর্তী

জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৪ ০৬:৪৫
Share:

খাবারের জন্য অপেক্ষা। —ফাইল চিত্র।

সে দিন বন্ধ রেডব্যাঙ্ক চা বাগানের ‘দুয়ারে’ রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। তখন বাম আমল। উত্তরের বন্ধ চা বাগানের সংখ্যা প্রতি মাসে বাড়ছে। দিকে দিকে বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভ শান্ত করতে, সমস্যা শুনতে বন্ধ বাগানে এসেছেন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। পাশে জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের তৎকালীন সভাধিপতি বনমালী রায়। মলিন পোশাক, হাড় জিরজিরে চেহারার চা শ্রমিকেরা মন্ত্রীর সামনে চলে যাচ্ছেন, কেউ বাধা দিচ্ছেন না।

Advertisement

কেউ বলছেন, শ্রমিক আবাসনের চালে ফুটো। বর্ষায় ঘরে জল পড়ে, শীত হিম। অর্থমন্ত্রী বলছেন, “করে দেব।” কেউ বলছেন, “বাগানে খাবার জলটুকুও নেই।” অর্থমন্ত্রী বলছেন, “করে দেব।” কেউ বলছেন, “বাগানে একটা হাসপাতাল হলে ভাল হয়।” অর্থমন্ত্রী বলছেন, “করে দেব।” সকলে মিলে বলছেন, “বাগান খুলে দিন।” অর্থমন্ত্রী শুনে বলছেন, “করে দেব।” সমস্যা মেটাতে বরাদ্দ প্রয়োজন, বাগানের ছেড়ে যাওয়া মালিকের সম্মতি প্রয়োজন। বনমালী রায়কে সে দিন সভায় প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “জেলা পরিষদের আনটায়েড ফান্ডের (যে তহবিল থেকে কোনও নির্দিষ্ট খাতে খরচের বিধিনিষেধ নেই) থেকে করে নাও।” তার পরেও অনেক বছর রেডব্যাঙ্ক চা বাগান বন্ধ ছিল। সমস্যাও মেটেনি।

গত লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ময়নাগুড়ির মাঠে এসে ঘোষণা করেছিলেন, জলপাইগুড়ির সব বন্ধ বাগান খুলেদিয়েছে কেন্দ্র, তখনও রেডব্যাঙ্ক বন্ধই ছিল। তারও আগে বেশ কয়েক বার তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ডুয়ার্সের পাঁচটি বন্ধ চা বাগান অধিগ্রহণের কথা বলেছিলেন। উত্তরের চা তল্লাট জানে, তার পরেও বন্ধ বাগানগুলির কারখানায় সাইরেন বাজেনি।

Advertisement

জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলা মিলিয়ে এমন বন্ধ এবং ধুঁকতে থাকা চা বাগানের সংখ্যা এখন দশের কাছাকাছি। তরাইয়ে আরও দু’টি বাগানে অচলাবস্থা চলছে। কখনও কাজ বন্ধ থাকে, কখনও চালু হয়। বর্তমান তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী গত ১১ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ির প্রশাসনিক সভা থেকে ছ’টি চা বাগান অধিগ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেছেন। ফের আশায় বুক বাঁধছেনচা শ্রমিকেরা।

বাম আমলে এক সময়ে উত্তরবঙ্গে বন্ধ চা বাগানের সংখ্যা তিরিশে পৌঁছে গিয়েছিল। রাজ্যে পালাবদলের পরে বন্ধ বাগানগুলি খুলতে শুরু করে। কিন্তু বছর তিনেক ধরে ফের বাগান বন্ধ হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে উত্তরে। অথচ, চা শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের দাবি, চায়ের দাম দেশের বাজারে সে ভাবে কমেনি। বিশ্ব বাজারে ভারতীয় চায়ের চাহিদাও অটুট। করোনা কালে চা বাগান বন্ধের সময়ে অনেকে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিলেন। যদিও করোনা কালে বিস্ময় ছড়িয়ে উৎপাদনে রেকর্ড করেছিল চা বাগান, দামও মিলেছিল ভাল। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভারতের সামনে বিশ্ব বাজারের বেশ কয়েকটি দরজা খুলে গিয়েছে। তার পরেও কেন উত্তরের চা বাগান বন্ধ হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে?

আলিপুরদুয়ার জেলায় যে ক’টি বাগান বন্ধ হয়েছে, সবই পুজোর আগে, বোনাস চুক্তির সময়ে। তা নিয়ে রাজনৈতিক টানাপড়েনও রয়েছে। সিপিএমের আলিপুরদুয়ার জেলা সম্পাদক কিশোর দাস বলেন, “বাম আমলে বোনাস দেওয়ার আগে কোনও বাগান বন্ধ হয়নি। চা বাগান কিংবা চা শ্রমিকদের নিয়ে শুধুমাত্র রাজনীতি করছে তৃণমূল আর বিজেপি।”

রাজ্য বিধানসভায় বিজেপির মুখ্য সচেতক মনোজ টিগ্গা নিজেও চা শ্রমিক। তাঁর অভিযোগ, “চা বাগান নিয়ে ব্যবসা করছে তৃণমূল নেতাদের একাংশ। নিজেদের মুনাফা অর্জনের তাগিদে মাঝেমধ্যেই কিছু ব্যবসায়ীকে দিয়ে বাগান খোলান তাঁরা। তার পরে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে এসে তাঁকে দিয়ে চা বাগান নিয়ে ভাল ভাল সরকারি উদ্যোগের কথা ঘোষণা করান। বাগান খোলার জন্য আবার কোনও একটা ভোট আসার অপেক্ষায় থাকতে হয় শ্রমিকদের।’’

মনোজের জেলার চা শ্রমিক নেতা প্রকাশ চিক বরাইককে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে তৃণমূল। প্রকাশের পাল্টা দাবি, “চা শ্রমিকদের নিয়ে সব সময় নিম্ন রুচির রাজনীতি করতে ব্যস্ত বিজেপি। ঘোষণা করেও প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত একটি চা বাগান অধিগ্রহণ করেননি। মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ টিগ্গারও নিজের এলাকার চা বাগানগুলোর উন্নয়নে কোনও হেলদোল নেই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী চা বলয়ের উন্নয়নে যথেষ্ট মানবিক।’’ তিনি এই সূত্রে চা শ্রমিকদের উন্নয়নে নানা প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি, ‘‘বন্ধ চা বাগান খুলতেও রাজ্য সরকার তৎপর। সম্প্রতি এ নিয়ে রাজ্যের মন্ত্রীদের বৈঠকও হয়। সেখানে আমিও ছিলাম।’’

প্রতি বছর রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় বাজেট প্রস্তাবে চা বাগান নিয়ে লেখায় এবং অঙ্কে বরাদ্দ হয়। কোনও দল চা শ্রমিকদের পাট্টা নিয়ে গলা ফাটায়, কোনও দল কল্যাণ তহবিলের কথা ঘোষণা করে। ভোট এলে সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়। অথচ স্থায়ী সমাধান হয় কোথায়?

তাই ফুল ফোটা বাগানে বসন্ত যেন দূর অস্ত্। (শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement