বুধবার আলোচনাসভায় অনুরাধা লোহিয়া, সুরঞ্জন দাস ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
ছাত্র নেতাদের সংযত হওয়ার বার্তা দিয়ে লাভ হয়নি। এ বার অধ্যক্ষ-উপাচার্যদেরই চাপের মুখে মাথা নত না-করার পরামর্শ দিলেন শিক্ষামন্ত্রী।
বুধবার একটি আলোচনাসভায় উপস্থিত বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ-উপাচার্যদের সামনেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শিক্ষক-উপাচার্য সকলের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। সরকার আপনাদের সঙ্গে আছে।” কিন্তু চাপ কোন পথে আসছে এবং সেই পথটি কী করে বন্ধ করা যায়, সে কথা মন্ত্রী বলেননি। ফলে তাঁর কথায় কাজের কাজ কতটা হবে, সে নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে শিক্ষাজগতে। রাজ্যের কলেজে কলেজে শাসক দলের ছাত্র নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা এবং তাঁর দলবল যে ভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে লাগাম না-পরিয়ে শিক্ষকদের বার্তা দিয়ে কী লাভ, উঠছে সেই প্রশ্নও।
তবে আজ, বৃহস্পতিবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠান রয়েছে। সেখানে মূল বক্তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উপস্থিত থাকবেন শিক্ষামন্ত্রীও। তার আগে পার্থবাবুর বুধবারের এই বার্তা কিছুটা হলেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে শিক্ষাজগত। এর আগে গত মাসের ২৮ তারিখ শিক্ষামন্ত্রী তৃণমূল ভবনে বৈঠক ডেকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন টিএমসিপি নেতৃত্বকে। কিন্তু দৃশ্যতই তাতে লাভ হয়নি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনও পছন্দ মতো ছাত্র ভর্তির দাবিতে, কখনও টোকাটুকিতে বাধাদানের বিরুদ্ধে শিক্ষক-অধ্যক্ষদের উপরে হেনস্থা চলছেই। বেশির ভাগ ঘটনাতেই অভিযোগের আঙুল টিএমসিপি-র দিকে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, টিএমসিপি-কে সরাসরি বার্তা দিয়েই যখন তাদের রাশ টানা যায়নি, তখন অধ্যক্ষদের শক্ত হতে বলার অর্থ কী? শিক্ষাজগতের অনেকেরই আশঙ্কা, শিক্ষামন্ত্রী চাইলেও ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় অধ্যক্ষদের উপরেই হাল ধরার দায় চাপিয়ে দিয়ে সরকার কার্যত নিজের অসহায়তাই প্রকাশ করল কি না, সেই সন্দেহ দানা বাঁধছে। কারণ ছাত্রনেতাদের মধ্যে যাদের কানে মন্ত্রীর বার্তা পৌঁছবে না, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার দিক-নির্দেশ এ দিন শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে মেলেনি। আইআইএম-এর অর্থনীতির শিক্ষক অনুপ সিংহ তাই বলছেন, “চাপের কাছে মাথা না নোয়ানো খুবই ভাল। কিন্তু চাপের উৎসটা কোথায়, সেটা তো মন্ত্রীকে দেখতে হবে। চাপের পথটি বন্ধ করতে না পারলে এ সব কথা ফাঁকা আওয়াজ হিসেবেই থেকে যাবে।”
শিক্ষাজগতের এই আশঙ্কাকে অনেকাংশে সত্য প্রমাণ করেই টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা যথারীতি মনে করছেন না যে, শিক্ষামন্ত্রীর এ দিনের বক্তব্যের সঙ্গে তাঁদের কিছুমাত্র যোগ আছে। শঙ্কুদেবের কথায়, “পার্থদার মন্তব্যকে স্বাগত। আমরা কাউকে চাপ দিই না। আমাদের বিরুদ্ধে কারও কোনও অভিযোগ নেই। এ সব সিপিএম, বিজেপি-র কানে গেলে হয়!” গত ২৮ জুলাই তৃণমূল ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরেও অনেকটা একই সুরে কথা বলেছিলেন শঙ্কু। পার্থবাবু সে দিন যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘেরাও-বিক্ষোভ, বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার কথা বলেছিলেন, শঙ্কু প্রকাশ্যে মানতে চাননি এগুলো তাঁদের উদ্দেশে বলা। এ দিনও তিনি সেই পথে হাঁটলেন। তা শুনে এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক দেবজ্যোতি দাসের মন্তব্য, “যা ঘটছে তা রাজ্যের মানুষ দেখছেন। ছাত্রছাত্রীরাও জানে কী হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর যাঁদের উদ্দেশে ওই বার্তা দিয়েছেন, তাঁদের কানেই সেটা পৌঁছয়নি দেখছি।” বিজেপি-র যুব মোর্চার সভাপতি অমিতাভ রায় বলেন, “সিপিএম শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়নের যে ধারা চালু করেছিল, টিএমসিপি তা-ই বজায় রেখেছে।”
সোমবারই টোকাটুকির দাবিতে নদিয়ার চাপড়ায় বাঙালঝি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষকে হেনস্থা করে টিএমসিপি। অধ্যক্ষ তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীর অনুরোধে এ দিনই তিনি শর্তসাপেক্ষে তা প্রত্যাহার করেছেন। তৃণমূল ছাত্র সংসদের চাপে ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়া বিবেকানন্দ কলেজে ইস্তফা দিয়েছিলেন টিচার ইন-চার্জ। হেনস্থার হাত থেকে বাদ যাননি উপাচার্যরাও। জুলাই মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠক চলাকালীন টিএমসিপি-র দৌরাত্ম্য নজিরবিহীন মাত্রা ছুঁয়েছিল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কলেজ পরিচালনায় নিজেদের অসহায়তার কথা সম্প্রতি মন্ত্রীকে খোলাখুলি জানিয়েছেন অনেক অধ্যক্ষই। গত ৮ অগস্ট মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তাঁরা বলেছিলেন, কলেজগুলির পরিচালন সমিতির যা গঠন, তাতে তাঁদের মত জানানোর জায়গাটা সীমিত। তার উপরে কখনও ছাত্র সংসদ, কখনও জনপ্রতিনিধির চাপে না-চাইলেও মাথা নত করা ছাড়া উপায় থাকে না।
শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বারবারই বলে আসছেন, তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির মাত্রাছাড়া দাপাদাপি চলতে দেবেন না। বুধবার তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বললেন, প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে যা করণীয়, নির্ভয়ে করতে। বার্তা দিলেন শৃঙ্খলা বজায় রাখার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস, প্রেসিডেন্সির উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া, শিবপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধিকর্তা অজয় রায় এবং কলকাতার বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষদের সামনেই এই অনুরোধ জানালেন তিনি। পার্থবাবু স্পষ্ট বললেন, “কে শিক্ষক হবেন, কে অধ্যক্ষ বা উপাচার্য হবেন, সেটা নির্বাচন করার অধিকার ছাত্রছাত্রীদের নেই। তারা পড়াশোনায় মন দেবে। এটাই তাদের কাছে কাম্য।”
তবে রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এই ‘কাম্য’ পরিবেশটাই যে নেই, সেটাই বারবার বোঝাতে চাইছেন অধ্যক্ষ-উপাচার্যরা। মন্ত্রীর কাছে তাঁদের প্রশ্ন, ছাত্র সংসদ যখন দাবিদাওয়া নিয়ে চড়াও হবে, তখন তাদের সামনে রুখে দাঁড়ানোর মতো কী রক্ষাকবচ সরকার দেবে? বিশেষত গ্রামাঞ্চলের কলেজগুলিতে যেখানে হাতের কাছে সব সময় থানা-পুলিশ নেই, সেখানে অধ্যক্ষরা রণং দেহি ছাত্র সংসদকে কী ভাবে সামলাবেন? পার্থবাবু পরে বলেন, “আমি আক্রান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে অভিযুক্ত ছাত্রছাত্রীদের নামের তালিকা চাইছি। আগে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নিক। সরকার তার পরে তা সমর্থন করবে।” কিন্তু টেবিল-চেয়ার ভাঙচুর করে, অধ্যক্ষের গায়ে হাত তুলে যারা বিক্ষোভ দেখায়, তাদের সামনে কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি অসহায় নয়? শিক্ষামন্ত্রীর জবাব, “এক বার তো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তার পরে এই ধরনের ঘটনা রোখা সহজ হয়ে যাবে।” অর্থাৎ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়টা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকেই ঠেলে দিয়েছেন পার্থবাবু।
অনেক শিক্ষাবিদ অবশ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোলমালের মূলটাকেই বিনষ্ট করা পক্ষে। তাঁরা তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতি একেবারে দূর করার পক্ষপাতী। ‘এমসিসি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ আয়োজিত আলোচনাসভায় এমসিসি-র সভাপতি সঞ্জয় অগ্রবাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত করার আবেদন জানান। উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “গণতান্ত্রিক অধিকার তো থাকবেই। কিন্তু তাতে একটা শৃঙ্খলাবোধ আমাদের সকলের মধ্যে রাখতে হবে।”