গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট। ‘রাজনৈতিক কৌশল রচয়িতা’ বললে হয়তো ইংরেজি এই শব্দবন্ধের কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। কিন্তু প্রশান্ত কিশোরের প্রকৃত কাজ বা পেশাকে ঠিক বোঝানো যায় না। কিন্তু এটা ঠিক, তিনি যেখানে গিয়েছেন, যাঁর সঙ্গে থেকেছেন, তিনিই সাফল্যের স্বাদ পেয়েছেন। নিজে অন্তরালে থেকেও নিয়োগকর্তাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে অধ্যবসায় চালিয়ে যানরাজনীতির ‘মেঘনাদ’ প্রশান্ত কিশোর ওরফে ‘পিকে’। যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। গুজরাত, বিহার, পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে এ বার এই প্রশান্তের গন্তব্য এ রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ। সৌজন্যে তৃণমূল। রাজ্যে দলের বিপর্যয় রুখে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে এবং বিজেপিকে রুখে দিতে এই প্রশান্ত কিশোরেরই হাত ধরছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু কে এই প্রশান্ত কিশোর? তাঁর সাফল্যের রসায়নই বা কী? জন্ম বিহারের রোহতাস জেলার কোরান গ্রামে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তাঁর বাবা পাকাপাকি ভাবে চলে যান বিহারেরই বক্সারে। অন্য দিকে ইঞ্জিনয়ারিং পড়তে হায়দরাবাদে যান প্রশান্ত। পড়াশোনার পাঠ চোকানোর পর কাজে যোগ দেন রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বাস্থ্য বিভাগে। কর্মস্থল ছিল আফ্রিকা। আট বছর চাকরির পর ২০১১ সালে ফিরে আসেন দেশে। তৈরি করেন নিজের সংস্থা সিটিজেন্স ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্নমেন্ট (সিএজি)। নিজের সংস্থায় নিয়োগ করেন আইআইটি-আইআইএম-এর পেশাদার লোকজনকে। পরের বছরই বিধানসভার ভোট গুজরাতে। ভোটের রণকৌশল তৈরি করতে এই প্রশান্ত কিশোরকেই নিয়োগ করেন তখনকার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
‘পিকে’র কাজটা সহজ ছিল না। কারণ ২০০১ সাল থেকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উন্নয়ন হলেও দীর্ঘদিন সরকারে থাকায় প্রশাসন বিরোধী হাওয়া ছিল। কিন্তু মোদীর সেই উন্নয়নের সঙ্গে ঐক্যের বার্তা জুড়ে ব্যাপক প্রচার-কৌশল রচনা করেন প্রশান্ত। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে গোটা গুজরাত জুড়ে প্রচারের এমন কৌশল তৈরি হয়, যাতে ফের ক্ষমতায় আসতে অসুবিধা হয়নি মোদীর। সেই সাফল্যের হাত ধরেই প্রশান্ত পান আরও বড় দায়িত্ব। গুজরাতের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরে নিজেকে তুলে ধরার দায়িত্বও তাঁর কাঁধেই সঁপে দেন মোদী। তার পরই তৈরি হয় ‘ব্লু প্রিন্ট’। সেই সময়ই প্রশান্তের মস্তিষ্ক থেকে বেরোয় ‘চায়ে পে চর্চা’, ‘রান ফর ইউনিটি’র মতো ‘মাস্টার স্ট্রোক’। আর সেই সবের হাত ধরেই দেশ জুড়ে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মোদী। ফল ২০১৪ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে উত্তরণ।
২০১২ সালে গুজরাতে ক্ষমতা ধরে রাখার অন্যতম কারিগর ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। —ফাইল চিত্র
কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দলের মধ্যেই শুরু হয় সঙ্ঘাত। মূলত অমিত শাহ এবং দলের আরও কয়েকজন নেতার সঙ্গে মনোমালিন্যে মোদীর ‘সঙ্গ’ ছাড়েন প্রশান্ত। সেই সময়ই নিজের সংস্থা সিএজি পরিবর্তন করে গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (আইপিএসি)। মার্কিন মুলুকের কানাডার সংস্থা পিএসির অনুকরণে নিজের সংস্থার নামকরণ করেন প্রশান্ত। মার্কিন মুলুকে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের ভোটপ্রচার এবং রণকৌশল তৈরির পেশাদার কাজ করে এই সংস্থা।
আরও পড়ুন: মমতার সঙ্গে বৈঠক, ভোটে বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলাতে প্রশান্ত কিশোরের হাত ধরছে তৃণমূল
আরও পড়ুন: নিশানায় তথাগত-লকেট, হাজরায় দিনভর অবস্থান বিক্ষোভে বঙ্গজননী বাহিনী
এর মধ্যেই ২০১৫ সালের গোড়ায় যোগ দেন নীতীশ কুমারের রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে। ওই বছরই বিহার বিধানসভার ভোট। জনতা পরিবার এবং কংগ্রেস মিলে মহাজোট তৈরি করে ভোটে লড়ে। তাতে বিপুল সাফল্য পায় মহাজোট। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হন নীতীশ কুমার। নীতীশের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা যায়, ওই সময় অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে সেখানকার সমস্যা বুঝে নীতীশের বক্তব্যের বয়ান তৈরি করে দিতেন প্রশান্ত। তাতে এলাকাবাসীও মনে করতেন তাঁদের কথাই বলতেন নীতীশ। নীতীশকে প্রায় সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেওয়ার জেরে এই সময়ই মূলত প্রচারের আলোয় আসেন প্রশান্ত। তার পরও নীতীশের উপদেষ্টা হিসেবে বেশ কিছু জনমুখী পরিকল্পনার রূপায়ন হয় তাঁর হাত ধরেই।
নীতীশ কুমারের সাফল্যের নেপথ্যেও প্রশান্ত কিশোর। —ফাইল চিত্র
নীতীশের জেডিইউ-এর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ না করেও এ বার প্রশান্তের হাত ধরে কংগ্রেস। প্রথমেই দায়িত্ব পান ২০১৬ সালের পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনের। তার আগের দু’টি নির্বাচনে হেরে কার্যত খাদের কিনারে কংগ্রেস। সেখান থেকে তুলে এনে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহের জয় নিশ্চিত করার কারিগর ছিলেন এই ‘পিকে’ই।
পরের বছরই উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ভোট। আবার দায়িত্বে প্রশান্ত কিশোর। কেরিয়ারের প্রথম এবং একমাত্র ধাক্কা প্রশান্ত খেয়েছেন গোবলয়ের এই রাজ্যেই। কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করলেও তাঁর সেই রণনীতি পুরোপুরি ফ্লপ হয়। মাত্র সাতটি আসন পায় কংগ্রেস। প্রতিপক্ষ শিবিরে তিনশোরও বেশি আসন নিয়ে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। রাজনৈতিক শিবিরে কান পাতলেই অবশ্য শোনা যায়, ওই সময়ই প্রিয়ঙ্কা গাঁধীকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেন পিকে। কিন্তু প্রিয়ঙ্কা এবং কংগ্রেস রাজি হয়নি। প্রিয়ঙ্কা সেই সময় এলে কংগ্রেসের ফল কী হত, সেটা অন্য কথা। কিন্তু ব্যর্থতা ব্যর্থতাই।
কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যাওয়া প্রশান্ত অবশ্য তাতে দমে যাননি। পরের গন্তব্য অন্ধ্রপ্রদেশ। নিয়োগকর্তা তথা ওয়াইএসআরসিপি সুপ্রিমো জগনমোহন রেড্ডি। প্রায় দু’বছর ধরে কাজ করার পর জগনকেও বিপুল সাফল্য এনে দিয়েছেন প্রশান্ত। একই সঙ্গে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অন্ধ্রের ক্ষমতায় বসে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন জগন। লোকসভাতেও ২৫ আসনের মধ্যে ২৩টি দখল করেছেন জগন। কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ চন্দ্রবাবু এবং তাঁর দল টিডিপি। মাঝে অবশ্য ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নীতীশের দলেই যোগ দেন প্রশান্ত। যদিও সেই কেরিয়ার খুব বেশি উজ্জ্বল নয়।
সম্প্রতি শেষ হওয়া লোকসভা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভার ভোটে জগনমোহন রেড্ডির হয়ে কাজ করেছেন প্রশান্ত কিশোর। বিপুল সাফল্য পেয়েছেন জগন। —ফাইল চিত্র
এ বার ডাক পড়েছে কলকাতায়। তৃণমূল নেত্রী তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা কার্যত পাকা। লোকসভা ভোটে দলের বিপর্যয় আটকে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত রুখে দেওয়ার রণনীতি তৈরি করবেন তৃণমূলের হয়ে। মমতার পাখির চোখ, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ফের ক্ষমতায় আসা। প্রশান্তের লক্ষ্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরও এক সাফল্যের স্বাদ পাইয়ে দেওয়া এবং নিজের বায়োডেটা আরও শক্তপোক্ত করা।
কিন্তু প্রশান্তের এই সাফল্যের রসায়ন কী? একাধিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং তাঁর সঙ্গে কাজ করা নীতীশ-জগনের মতো নেতাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রে খবর, প্রথম সূত্র রিসার্চ বা গবেষণা। কার্যত প্রতিটি বুথ ধরে সমীক্ষা করে সেখানকার সমস্যা জেনে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, পেশাদারদের দিয়ে অভিনব প্রচার ও রাজনৈতিক কর্মসূচি তৈরি করা এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা রূপায়ণের পন্থা বাতলে দেওয়া। এর সঙ্গে পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা বুঝে সেই অনুযায়ী ঘুঁটি সাজানো। এর সঙ্গে বিভিন্ন রকম সমীকরণ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা, এবং খামতি দূর করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার পরিকল্পনা করাও প্রশান্তের সাফল্যের চাবিকাঠি।