পুরনো সেই দিন: বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রকাশ কারাট। —ফাইল ছবি।
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৭৪ সালে। সে সময়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গে ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য সম্পাদক। তখন অফিস ছিল লোয়ার সার্কুলার রোডে। সেখানে এসএফআই-এর অফিসও ছিল। মনে পড়ছে, যখন আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ করিয়ে দেওয়া হল, বুদ্ধদেব ডেস্কে বসে প্রবল গতিতে কিছু লিখছিলেন।
বুদ্ধদেব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতা। আগের প্রজন্মে ছিলেন জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়ের মতো নেতারা। যাঁরা দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বয়সের দিক থেকে খুবই কাছাকাছি ছিলাম। উনি বয়সে আমার থেকে মাত্র চার বছরের বড়। জরুরি অবস্থার পরে আমাদের মধ্যে নতুন করে যোগাযোগ তৈরি হল। ১৯৮৫ সালে আমরা সব একসঙ্গে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পেলাম। সে বছর কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক তরুণ মুখ তুলে আনা হল। বাংলা থেকে বুদ্ধদেব, বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস। এখান থেকে আমি, সীতারাম। তারপরে পলিটব্যুরোতে একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হল। গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত বিষয়, রাজনৈতিক প্রশ্নে আলোচনা, তর্কবিতর্কের মধ্যে দিয়ে আমরা আরও ভাল করে একে অপরকে বুঝলাম। একটা ‘কমন বন্ড’ তৈরি হল। কোনও বিষয়ে আমাদের মতভেদ হলেও এটুকু জানা ছিল, আমরা একই মতাদর্শের জায়গা থেকে কথা বলছি।
বুদ্ধদেব যে বাম সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হবেন, সেটা গোড়া থেকেই নির্ধারিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে প্রথম বাম সরকারেই তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন। যাত্রাপথ তখনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ২০০০ সালে জ্যোতি বসু অব্যাহতি নেওয়ার পরে বুদ্ধদেব মুখ্যমন্ত্রী হলেন। সে সময় পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের সবথেকে মজবুত দুর্গ। একটা সময়ে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, ত্রিপুরা তিন রাজ্যে বাম সরকার থাকলেও জাতীয় রাজনীতিতে ওজনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের সরকার ছিল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাজ্যের নেতাদের সঙ্গে সর্বভারতীয় নেতৃত্বকে সব সময় কথা বলতে হল। জ্যোতিবাবুর সময়ে উনি কমরেড সুরজিৎ, ইএমএস-এর সঙ্গে কথা বলতেন। আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়মিত বুদ্ধদেবের সঙ্গে কথা বলতে হত। বিশেষত উনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে। তবে কখনও লম্বা তর্কবিতর্কের দরকার পড়ত না। আমার কোনও কথায় একমত না হলে উনি শুধু দু’টো শব্দ বলতেন। তাতেই বুঝে যেতাম। আর ব্যাখ্যা করতে হত না। এত দিন ধরে একসঙ্গে কাজ করতে করতে সেই বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। নীতিগত অনেক বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। অনেক ক্ষেত্রে হইনি। তার জন্য ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ হয়নি।
বুদ্ধদেবের কথা ভাবলে একটা বিষয় প্রথমেই মনে হয়। উনি দলের অনুগত কর্মী হলেও আর পাঁচজন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বা ক্যাডারের থেকে আলাদা ছিলেন। কারণ, ওঁর বৃহত্তর বিষয়ে আগ্রহ ছিল। সবথেকে বড় আবেগের জায়গা ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতি। বরাবরই জানা ছিল, ওঁর প্রশাসনিক, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক কাজের বাইরে জীবনের একটা কোণ সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার জন্য রাখা থাকে। যখনই দেখা হত, বলতেন, প্রতি দিন সন্ধ্যায় নন্দনে গিয়ে এক-দেড়ঘন্টা সময় কাটানোটাই ওঁর দিনের সেরা সময়। এই বৃহত্তর বিষয়ে আগ্রহ আমাদের সকলের মধ্যে দেখা যায় না।
আমি বাংলা পড়তে পারি না। তাই বুদ্ধদেবের লেখা পড়া হয়নি। তবে বুদ্ধদেব সঙ্কীর্ণমনা ছিলেন না। শুধু বাংলা সাহিত্য নিয়ে থাকতেন না। গোটা বিশ্বে সাহিত্যের জগতে কী হচ্ছে, কী নতুন লেখালেখি হচ্ছে, তা উনিই আমাকে জানাতেন। পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগোর কথা ওঁর থেকেই প্রথম শোনা। যিনি নোবেল পেয়েছিলেন। এ সব বিষয়ে উনি একেবারে ‘আপ-টু-ডেট’ থাকতেন। ওঁর কথাতেই সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপন্যাস পড়েছিলাম। আমার নিজের পছন্দের ইয়ান র্যানকিনের গোয়েন্দা উপন্যাসের কথা বলেছিলাম। ও সবে ওঁর ঝোঁক ছিল না। বুদ্ধদেবের ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা অভিনবত্ব, একটা প্রভা ছিল। তার মধ্যে অনেক কিছু প্রতিফলিত হত। ব্যক্তিগত জীবনে বুদ্ধদেবের মতো আর কাউকে আমি মন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েও একই রকম জীবনযাত্রা বজায় রাখতে দেখিনি। সেই পাম অ্যাভিনিউয়ের দু’কামরার ফ্ল্যাটেই কাটিয়ে দিলেন। ফ্ল্যাটে গেলে মনে হত, কেন ছোটখাটো মেরামতির কাজও করান না। আসলে এ সব দিকে ওঁর নজরই ছিল না।
গত বছর ওই ফ্ল্যাটেই ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা। দৃষ্টিশক্তি কমে গিয়েছিল। তাই বই পড়তে পারতেন না। সেটা ওঁর কাছে খুবই কষ্টদায়ক ছিল। ওঁকে ওই অবস্থায় দেখা আমার কাছেও ছিল খুবই যন্ত্রণাদায়ক।
(সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক)