দেবশঙ্কর হালদার ও নাট্যকার ও নির্দেশক ঈশিতা মুখোপাধ্যায়
প্রত্যেক মাসের মতো গত ১২ সেপ্টেম্বর কনক্লেভ-এ প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন-এর নির্মিত আখর বাংলা ও পূর্ব-পশ্চিম নাট্য দলের উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন নাট্যজগতের দুই বিদগ্ধ ও খ্যাতনমা ব্যক্তি— দেবশঙ্কর হালদার ও নাট্যকার ও নির্দেশক ঈশিতা মুখোপাধ্যায়। বলা বাহুল্য শুধু মনোগ্রাহী নয়, এই আলোচনায় থিয়েটার বা নাটকের নানা দিগন্তের অন্বেষণ হয়। প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ও ভারতীয় বেশ কয়েকটি ভাষা নিয়ে কাজ করে চলেছে। তাদের সৃষ্টি আখর বাংলা যা বাংলা ভাষা বা তার সম্পৃক্ত বিষয়গুলি নিয়ে প্রত্যেক মাসে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আলোচনার শুরুতেই দেবশঙ্কর হালদার বলেন যে, থিয়েটার এমন একটি আর্ট যার ভিতরের অনেক কথা থাকে। সেই কথাগুলো নিয়ে সবসময় আলোচনা হয় না, কিন্তু সে কথাগুলো জানলে আমাদের সকলের সুবিধে। আলোচনার প্রারম্ভে তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর কবিতা ‘শূণ্যের আড়াল থেকে একটি মুখ ভেসে আসে’ পাঠ করেন। প্রত্যেক সত্যের যমজ রয়েছে, শব্দের নির্মাণে কিছু মিথ্যে থেকে । নাট্যকার বা নির্দেশক যেমন ভাবে নির্মাণ করতে চান তা কি আসলে নির্মিত করা যায়?
দেবশঙ্কর হালদার
ঈশিতা মুখোপাধ্যায়ের নাটক ‘গহরজান’, ‘কমলেকামিনী’ বা ‘বাবাই’ নাটকের উল্লেখ করে দেবশঙ্কর হালদার জানতে চান যে নাটকে নির্মাণের সময় যে সত্য নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তা কি হয়েছিল? এর উত্তরে ঈশিতা মুখোপাধ্যায় বলেন, কেমন করে তাঁর ভিতরের জমে থাকা কথাগুলো কালি-কলমে প্রকাশ পায়। তারা যেন তখন তাঁর চেতনার বন্ধু। যখন সেটা সংগঠিত হয় অর্থাৎ নাটকের জন্য লেখা হয় তখন অনেক কিছু মাথায় রেখে লিখতে হয়। চেতনার যে স্তর থেকে আমি লিখেছি আর নাটকটি যখন তৈরি হয় তার যে চেতনার স্তর তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সবসময় মিল থাকে না। তাঁর মতে নাট্যকারের বা নির্দেশকের দ্বিতীয় সত্ত্বা অভিনেতা। এক বড় অভিনেতা তাঁর ব্যক্তিত্বের ছাপ তাঁর অভিনয়ে রাখবেনই। সেটা পছন্দ নাও হতে পারে। তিনি যেমন একটি চরিত্রকে জ্যান্ত করছেন আবার সেটা যখন করছেন তাঁর ব্যক্তি মানুষের অভিজ্ঞতা, তাঁর মেধা, তাঁর ব্যক্ত্বিত্বের একটা ছাপ রয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্যক্তি মানুষ হিসাবে যিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এখানে একটা দ্বন্দ্ব হতেই পারে।
ঈশিতা মুখোপাধ্যায়
এই ব্যাপারে যদিও দেবশঙ্কর হালদারের মত একটু ভিন্ন। তাঁর মতে তিনি যখন কোনও নাটক করতে সম্মত হন যিনি নাটকটি লিখেছেন, নির্মাণ করছেন তিনি যেই সত্যটা দেখাতে চেয়েছেন বা আবিষ্কার করেছেন সেইটা তাঁকে দেখিয়েছেন। আমার মনে হয় সেই যে সত্যটা আমাকে তিনি দেখিয়েছেন সেটাই সত্য। তাঁর মতে নাট্যকার এবং নির্দেশক যেভাবে একটি চরিত্রকে নির্মাণ করতে চাইছেন অভিনেতার কাজ সবসময় সেটাকে মান্যতা দেওয়া। যদি তাঁর মনে হয় সেটা তিনি পারছেন না বা হচ্ছে না সেটা আলোচনা করা প্রয়োজন। আলোচনা চলে আরও নানা আঙ্গিক থেকে। ঈশিতা মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশিত নাটক নিয়ে নানা কথা উঠে আসে আলোচনায়। উঠে আসে দেবশঙ্কর হালদারের অভিনয় এবং তাঁর নির্মিত বাচ্চাদের নাটকের কথাও। নাটকের সংলাপ নিয়েও চলে বিস্তারিত আলোচনা। সব মিলিয়ে অত্যন্ত জরুরি বেশ কিছু বিষয় উঠে আসে এই আলোচনায় যা উপস্থিত সকলকে ঋদ্ধ করেছে।
এক দর্শক সূপর্ণা হালদার জানিয়েছেন, ‘দেবশঙ্কর আর ঈশিতা দু’জনকেই আমি ব্যক্তিগত পরিসরে চিনি। থিয়েটার সম্পর্কিত আজকের এই আলোচনায় বেশ কিছু নতুন চিন্তাভাবনা উঠে এসেছে। খুবই মনগ্রাহী আলোচনা।’
সূপর্ণা হালদার
বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র মিত্রর মতে, প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন ও আখর প্রত্যেক মাসেই এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। আজকের সভায় যে দু’জন উপস্থিত ছিলেন তাঁরা দু’জনেই নাটকের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। দেবশঙ্কর হালদারের তো নতুন করে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ঈশিতা মুখোপাধ্যায় একজন বলিষ্ঠ ও সুপ্রতিষ্ঠিত নাট্যকার ও নির্দেশক। আজকের এই আলোচনায় উপস্থিত সকলে ঋদ্ধ হয়েছি। থিয়েটার, নাটকের এক নতুন দিকের অন্বেষণ হল।
সৌমিত্র মিত্র
টলি জগতের অন্যতম অভিনেতা শুভাশিস মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আখর-এর এই ধরনের অনুষ্ঠানে আমি আগেও এসেছি। পূর্ব-পশ্চিম নাট্য দলও এর সঙ্গে যুক্ত। ভাষা চর্চা বা তার সঙ্গে যুক্ত যে বিষয়গুলি সেগুলি নিয়ে আলোচনা হয়। আজকে যেই আলোচনা হল তাতে যে দু’জন নাট্যব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন দু’জনেই খ্যাতনামা ও বিদগ্ধ। এই ধরনের অনুষ্ঠান আরও হওয়া উচিৎ।
শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
যে তরুণ প্রজন্ম থিয়েটারে আছেন বা আসবেন বলে ঠিক করেছেন এই ধরনের অনুষ্ঠান তাদের খুবই সাহায্য করবে। আমার মনে হয় ভাল কথা বলার লোকের বড় অভাব। যে জ্ঞান বা পাণ্ডিত্য থিয়েটারের জন্য প্রয়োজন যাদের মধ্যে আছে তাদের মধ্যে এঁরা দু’জন অন্যতম। সিনিয়র যাঁরা যেমন রুদ্রদা, বিভাসদা, অশোকদা, অরুণদা এঁরা নমস্য ব্যক্তি। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মে এঁরা তো আছেন। তাই এরকম আলোচনা সভা আরও যত হবে পরবর্তীতে তরুণ প্রজন্ম আরও উদ্বুদ্ধ হবে।