ফাইল চিত্র।
যাই যাই করেও পুরোপুরি যাচ্ছে না সে। নতুন সংক্রমণ কোথাও কোথাও চিন্তার কারণ তো হয়ে উঠছেই। সর্বোপরি বিদায়ের পথে অনেকটা এগিয়েও পুরনো রোগীদের শরীরে ও মনে দাগ রেখে যাচ্ছে করোনা। চিকিৎসকদের চোখে রোগী সেরে উঠেছেন, কিন্তু মূলত ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট আর অনিদ্রার ঝক্কি থেকেই গিয়েছে। এই তিন সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে মহিলাই বেশি। আবার ক্লান্তিভাবের সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সিদের। দেখা গিয়েছে, সমীক্ষাভুক্ত এক হাজার জনের মধ্যে প্রতি ২৭ জনে এক জনের মৃত্যু হয়েছে, অর্থাৎ মৃত্যুহার ৩-৪%। সে-ক্ষেত্রে পুরুষের হার বেশি।
এমনই তথ্য পাওয়া গিয়েছে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি’ বা আইআইসিবি-র গবেষক এবং বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের চিকিৎসকদের যৌথ গবেষণায়। মোট ১৬০০ রোগীর উপরে গবেষণা চালানো হয়েছিল।
অতিমারি পরিস্থিতিতে চিকিৎসক শিবিরের পর্যবেক্ষণ, করোনা থেকে সেরে উঠলেও বিভিন্ন সমস্যা জাঁকিয়ে বসছে শরীরে। সেই ‘লং কোভিড’ বা দীর্ঘস্থায়ী কোভিডের জেরে বেগ পেতে হচ্ছে রোগীদের। কী ধরনের সমস্যা সব থেকে বেশি ভোগাচ্ছে, তা জানতে ‘পোস্ট কোভিড টেলিফোনিক সার্ভে’ বা করোনা-উত্তর ফোন সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। ২০২০-র এপ্রিল থেকে ২০২১-এর এপ্রিল— এই এক বছরে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল থেকে যত করোনা রোগী ছুটি পেয়েছেন, তাঁদের মধ্য থেকে এক হাজার জনকে খুঁজে নেন গবেষকেরা। গবেষণার জন্য তৈরি করা প্রশ্নমালা ধরে ওই রোগীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। একটি গুগল ফর্ম তৈরি করেও সমীক্ষা চালানো হয়েছিল সারা দেশে। তাতে বিভিন্ন প্রান্তের ৬০০ জন রোগী যোগ দেন।
বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের অধ্যক্ষা অণিমা হালদার, উপাধ্যক্ষ আশিস মান্নার সঙ্গে এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বক্ষঃরোগ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক কৌশিক চৌধুরী (গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর), সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ যোগীরাজ রায় ও সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়, বক্ষঃরোগ চিকিৎসক শেখররঞ্জন পাল। আইআইসিবি-র তরফে ছিলেন গবেষক দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় ও জিৎ সরকার। সম্প্রতি ওই গবেষণার পর্যবেক্ষণ প্রকাশ্যে এসেছে। দীপ্যমানবাবু বলেন, ‘‘পোস্ট কোভিডে যে-তিনটি সমস্যা সারা বিশ্বে প্রায় একই রকম, তা হল ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট আর অনিদ্রা। আমাদের গবেষণাতেও সেগুলি উঠে এসেছে। পোস্ট কোভিডে ক্লান্তি একটা বড় উপসর্গ। তার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট ও ঘুমের সমস্যাও রয়েছে। অনেকেই মনের ভুল বলে ধরে নিয়ে সেগুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কিন্তু ওই সব উপসর্গ বা সমস্যার কারণ এ বার গবেষণা করে দেখা প্রয়োজন।’’
আইডি হাসপাতালের এক হাজার রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, তাঁদের কেউ মৃদু বা মাঝারি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কেউ কেউ সঙ্কটজনক অবস্থায় ছিলেন আইসিইউ-তেও। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এক হাজার রোগীর মধ্যে ক্লান্তিভাব রয়েছে ১৩-১৪ শতাংশের, শ্বাসকষ্টে ভুগছেন ১১-১২ শতাংশ এবং ৭-৮ শতাংশ রোগীর ঘুমের সমস্যা বা অনিদ্রা রয়েছে। আর এই সমস্ত সমস্যা বেশি মহিলাদের ক্ষেত্রে।
প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর কৌশিকবাবু জানাচ্ছেন, গবেষণায় প্রকৃত তথ্য তুলে আনার জন্য রোগীর ক্ষেত্রে কোনও বাছবিচার করা হয়নি। মৃদু থেকে সঙ্কটজনক— সব রকমের করোনা রোগীর তথ্যই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। করোনা-পরবর্তী মৃত্যুর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, কেউ করোনা থেকে সেরে ওঠার দু’দিন পরে, কেউ আবার ছ’মাস পরে মারা গিয়েছেন। সব মিলিয়ে আনুপাতিক হিসেব কষে দেখা গিয়েছে, করোনা-পরবর্তী পর্যায়ে গড়ে ৩৯ দিন পরে মৃত্যু হয়েছে। ‘‘যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়া এবং হার্ট ফেলিয়োর— কোনটা বেশি, সেটাও সমীক্ষা করে দেখার পরিকল্পনা করা হয়েছে,’’ বলেন কৌশিকবাবু।
গবেষণায় আরও কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। যেমন, আইসিইউয়ে ভর্তি যে-সব করোনা রোগীর রক্তচাপ ও সুগারের পুরনো সমস্যা ছিল, করোনা-পরবর্তী পর্বে তাঁদের সমস্যা বেশি হয়েছে। ছুটির তিন মাসের মধ্যে বিভিন্ন উপসর্গ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, কয়েক মাস পরে সেই সমস্যা কমতে শুরু করে। অন্য দিকে, ওয়েব সমীক্ষায় যোগ দেওয়া ৬০০ জনের তথ্য থেকেও উঠে এসেছে ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট এবং অনিদ্রার সমস্যার কথা।