পুজোয় রাজনীতি, রাজনীতিতে পুজো 

ভিআইপিদের দিয়ে পুজো উদ্বোধনে উদ্যোক্তাদের উৎসাহের কারণ কী? এটা কি নিজ নিজ এলাকায় পুজো কমিটির ‘দাদা’দের প্রভাব দেখানো, না কি নেতা-মন্ত্রীদের ‘নেক নজরে’ থাকার সহজ পথ? 

Advertisement

স্যমন্তক ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৫০
Share:

হাওড়ার একটি পুজোর উদ্বোধনে করিশ্মা কপূর। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

কোথাও মুখ্যমন্ত্রী, কোথাও রাজ্যপাল, কোথাও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা কোনও বড় নেতা, আবার কোথাও রুপোলি পর্দার তারকা— পুজো উদ্বোধনে তাঁদের নিয়ে টানাটানি।

Advertisement

ছবিটা নতুন নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বরং কলকাতায় শতাধিক পুজো উদ্বোধনের দায়িত্ব তিনি একাই বহন করেন। তুলনায় অন্যেরা কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও নেতা-ভিআইপিদের দিয়ে পুজো উদ্বোধনের ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

প্রশ্ন কেন? ভিআইপিদের দিয়ে পুজো উদ্বোধনে উদ্যোক্তাদের উৎসাহের কারণ কী? এটা কি নিজ নিজ এলাকায় পুজো কমিটির ‘দাদা’দের প্রভাব দেখানো, না কি নেতা-মন্ত্রীদের ‘নেক নজরে’ থাকার সহজ পথ?

Advertisement

উত্তর একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না। দাদাদের পাড়ায় প্রভাব বৃদ্ধি বা ক্ষমতাসীনদের নেক নজরে থাকা যদি এর একটি কারণ হয়, তা হলে নেতা-মন্ত্রীদের দিক থেকে এলাকায় পুজো উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নিবিড় জনসংযোগ তৈরি করার চেষ্টাও এর আর একটি বড় কারণ। অর্থাৎ, ‘স্বার্থ’ এখানে পারস্পরিক।

বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের জমানায় রাজ্যের মন্ত্রী বা শাসক নেতাদের পুজো উদ্বোধনে পাওয়া যেত না। সেটা ছিল তাঁদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। যদিও সুভাষ চক্রবর্তীর মতো ডাকাবুকো কেউ কেউ পুজো মণ্ডপে গিয়েছেন, প্রদীপও জ্বেলেছেন। কারণ তিনি মনে করতেন এত বড় উৎসবে এই যোগাযোগটুকু না রাখলে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হবে। এই বিতর্কের বাইরে বামেরা জনসংযোগের অঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন পুজো মণ্ডপের সামনে বইয়ের স্টল খোলেন আজও।

বামফ্রন্ট আসার আগে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ও পুজো উদ্বোধন করেছেন। মমতার মতো শতাধিক পুজোয় না গেলেও, কলেজ স্কোয়্যার, বাগবাজার সর্বজনীন ইত্যাদি বাছাই পুজোয় যেতেন সিদ্ধার্থশঙ্কর। মমতা ক্ষমতায় এসে পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরকারের একটি যোগসূত্র তৈরি করে দেন। সেখানে পুজো কমিটিগুলিকে নানা রকম সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করে তিনি সামগ্রিক ভাবে দুর্গোৎসবের অঙ্গনে নিজের ‘চাহিদা’ বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। এ ছাড়া পুজোর সরকারি পুরস্কার চালু, রেড রোডে বিসর্জনের কার্নিভাল— এ সব মিলিয়ে মমতার আমলে পুজো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বের ‘নজর’ কেড়েছে। ফলে পুজো উদ্যোক্তাদের সকলেরই প্রথম পছন্দ থাকে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া।

এ বছর বিতর্ক তৈরি হয়েছে পুজোর ময়দানে বিজেপি ঢুকে পড়ায়। শেষ পর্যন্ত বিজেপির ‘পুজো দখল’ অভিযান নজর কাড়া সাফল্য পায়নি। আপাতত সল্টলেকে অমিত শাহের হাতে একটি পুজোর উদ্বোধনের মধ্য দিয়েই তাদের এবারের মতো মমতার সঙ্গে ‘পাল্লা’ দেওয়া শেষ করতে হয়েছে। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে কিছু পুজোর উদ্বোধন করেছেন।

ফলে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে শিবির ভাগাভাগি একেবারে হয়নি, তা নয়। অনেকের মতে, কোন এলাকায় কাদের ‘জোর’ বেশি এবং কোন ক্লাব কোন দলের ‘হাতে’ তার একটা ছবি এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।

রুপোলি পর্দার তারকাদের দিয়ে উদ্বোধন করানোর বিষয়টি অবশ্য একেবারে ভিন্ন। সেখানে ক্লাবের কোনও দাদার ব্যক্তিগত প্রভাব এবং অর্থবল দু’টোই কম বেশি কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে পেশাদার তারকারা আসেন প্রভাবের চাপে, অনেক ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে।

তবে নেতা বা অভিনেতা যিনিই আসুন, উদ্বোধনের মঞ্চে ভারী মাপের কারওকে তুলে দিতে পারলে প্রথম হাসি ক্লাবের দাদাই হাসেন। প্রবীণ রাজনীতিক এবং শহরের নামী একটি পুজোর উদ্যোক্তা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও এটা স্বীকার করেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজনীতি সংস্কৃতির বাইরে নয়। রাজনীতিক সেটাকে ব্যবহার করবেন, এটাই স্বাভাবিক।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের খোলাখুলি মন্তব্য, ‘‘পুজো রাজনীতি থেকে বিযুক্ত থাকা অসম্ভব। আজ যে ক্লাব পুজো করছে, কাল তো সে-ই ভোটের মেশিনারি হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement