ক্ষতবিক্ষত: সন্দেশখালিতে এক বিজেপি কর্মীর বাড়ির হাল। ছবি: নবেন্দু ঘোষ
ভোট পরবর্তী সন্ত্রাসের উপরে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হল না বুধবারও। উত্তর ২৪ পরগনার নানা প্রান্ত থেকে গোলমালের খবর আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসের শিকার বিরোধীরা।
গোলমাল অব্যাহত সন্দেশখালি-হিঙ্গলগঞ্জে। মঙ্গলবার রাতে, বুধবার দুপুরেও দুই বিধানসভার বিভিন্ন গ্রামে বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে ভাঙচুর করে লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ। মঙ্গলবার রাতে হিঙ্গলগঞ্জ বিধানসভার পারঘুমটি গ্রামে ১৫টি বাড়িতে, রূপমারিতে ১৪টি বাড়িতে, মাধবকাটিতে ৪টি বাড়িতে, খুলনা, হাটগাছা, শিতলিয়া, ভবানীপুর ১ ও ২ পঞ্চায়েত এলাকায় বেশ কিছু বাড়ি-দোকানে ভাঙচুর করে লুঠ করা হয়েছে বলে অভিযোগ বিজেপির। হিঙ্গলগঞ্জ বিধানসভার বিজেপি নেতা নিমাই দাস বলেন, ‘‘ফল ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিন আমাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি ও দোকানে হামলা চলছে। সেই সঙ্গে বাড়ি ও দোকান থেকে লুঠ করা হচ্ছে জিনিস। অনেক কর্মী ভয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। পুলিশকে বার বার বলছি, কিন্তু কোনও কাজ হচ্ছে না।’’ হিঙ্গলগঞ্জের বিধায়ক দেবেশ মণ্ডল অবশ্য বলেন, ‘‘এমন ভাবে মানুষকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। আমরা দ্রুত কড়া পদক্ষেপ করব।’’
সন্দেশখালি বিধানসভার ছোট শেয়েরা এলাকায় বিজেপির এক বুথ সভাপতি সুকদেব প্রধান বলেন, ‘‘বুধবার দুপুরে তৃণমূল আমার বাড়িতে এসে জানলার সব কাচ ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। দোকানে ভাঙচুর করেছে।” সুকদেব আরও বলেন, ‘‘ছোট শেয়েরা এলাকায় আরও বেশ কিছু বিজেপি কর্মীর বাড়িতে বুধবার দুপুরে ভাঙচুর করা হয়েছে।’’ সন্দেশখালির তৃণমূল বিধায়ক সুকুমার মাহাতো অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘এমন ঘটনা ঘটে থাকলে কেউ তো একবার আমাকে ফোন করে জানাতে পারেন। আমাকে তো কেউ জানাননি। জানালে অবশ্যই আমি দেখব, এমন কিছু যাতে না হয়।’’
রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চলেছে বসিরহাট মহকুমার নানা প্রান্তেও। ঘরছাড়া অনেকে। অশান্তি ঠেকাতে বুধবার বিকেলে বিজেপি বসিরহাট পুলিশ জেলার সুপারকে স্মারকলিপি দিয়েছে। বিজেপির জেলা সভাপতি তারক ঘোষ বলেন, ‘‘এই মহকুমায় ইতিমধ্যে শ’পাঁচেক পরিবারের দোকান, বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। অনেককে মারধর করা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চলছে। মহিলাদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।’’ তাঁর অভিযোগ, তৃণমূলের লোকজনই এ সব কাণ্ড ঘটাচ্ছে। বুলডোজার চালিয়ে ঘর-দোকান ভাঙছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।
অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করে রাজ্য তৃণমূল যুব সাধারণ সম্পাদক বাদল মিত্র বলেন, ‘‘কোনও রকম হিংসা বরদাস্ত করা হবে না। যে দলেরই হোক, মানুষকে যারা শান্তিতে বাস করতে দেবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশকে বলা হয়েছে।’’
বুধবার সন্দেশখালির ন্যাজাটের বিজেপির মহিলা মোর্চার কর্মী শান্তি মণ্ডলের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট করা হয় বলে অভিযোগ। বিজেপি কর্মী নিমাই চৌকিদারের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে তাঁকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। সেহেরা এলাকায় বেশ কয়েকজন বিজেপি কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর করে আগুন লাগানো হয় বলে অভিযোগ বিজেপির। মালঞ্চ, বামনপুকুর, কালীনগর বাজারে ৩০টির মতো দোকানে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বিজেপির। বহু ধানের গোলায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের নেতারা। সন্দেশখালির কোড়াকাটি গ্রামের পারুল মণ্ডল, সঞ্জনা মাহাতো বলেন, ‘‘সন্ধ্যা নামলেই তৃণমূলের বাইক বাহিনী বাড়ি বাড়ি ঢুকে পুরুষদের না পেয়ে মহিলাদের শ্লীলতাহানি করছে। ভয়ে অনেকে পালাচ্ছে।’’ সন্দেশখালির বিজেপি নেতা বিকাশ সিংহ বলেন, ‘‘নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার জন্যই আমাদের কর্মীদের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ হচ্ছে। প্রশাসনকে বার বার জানানো সত্ত্বেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’’ হাড়োয়ার উচিলদহ গ্রামে বিজেপি কর্মীদের বাড়িতে ভাঙচুর, ভেড়ির মাছ লুটের অভিযোগ উঠেছে। মিনাখাঁর বিজেপি নেতা জয়ন্ত মণ্ডলও সন্ত্রাসের অভিযোগ করছেন।
মিনাখাঁর তৃণমূল নেতা মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল বলেন, ‘‘এ রকম কিছু ঘটনা এলাকায় ঘটেছে। তবে এর জন্য দায়ী বিজেপির কিছু নেতাদের উস্কানিমূলক কথাবার্তা। আমাদের কর্মীদের বলা হয়েছে, তারা যেন কোনও রকম বেআইনি কাজে জড়িয়ে না পড়ে।’’
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টা একদল লোক হামলা চালায় গোপালনগরের একটি বাড়িতেও। বাড়ির মালিক এবং তাঁর স্ত্রী প্রতিবাদ করলে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। বাড়ির মালিক সাহেব আলি মণ্ডলকে রড-বাঁশ নিয়ে তাড়া করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে সিপিএম কর্মী সাহেব পালিয়ে একটি বাওরে ঝাঁপ দেন। রাতে অন্ধকারে প্রায় একশো মিটারে বেশি জলপথ সাঁতারে ডাঙায় ওঠেন বলে তাঁর দাবি। মারধর করা হয়েছে তাঁর স্ত্রী ময়নাকে। অভিযোগ, তাঁকে পা ধরে উঠোনে ঘোরানো হয়েছে। আশপাশের লোকজন এবং পুলিশ চলে আসায় দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়। বামনডাঙা এলাকার এই ঘটনায় পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। ময়না বলেন, ‘‘আগে আমরা তৃণমূল করতাম। আমপানে ঘরবাড়ি, চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আর্থিক সাহায্য পাইনি। এ বার আমরা সিপিএমকে সমর্থন করেছিলাম বলেই বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে।’’ আতঙ্কিত সাহেব এখনও বাড়িতে ফিরতে পারেননি। বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী পীযূষকান্তি সাহা বলেন, ‘‘ভোটে যে যার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছেন। ফল প্রকাশের পরে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়ে কী বোঝাতে চাইছে!’’
হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। দলের নেতা সৌমেন দত্ত বলেন, ‘‘তৃণমূল কোনও হামলা-অশান্তির ঘটনায় জড়িত নয়। আমাদের কর্মী-সমর্থকদের উপরেরই বিরোধীরা হামলা চালাচ্ছে। কয়েকজন জখম হয়েছেন।’’
তৃণমূলের দাবি, গোপালনগরের দমদমা এলাকায় তাঁদের এক পঞ্চায়েত সদস্যকে মারধর করা হয়েছে। রামচন্দ্রপুর এলাকায় দলীয় এক কর্মীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে তৃণমূলের পক্ষ থেকে বনগাঁ থানার বিক্ষোভ দেখানো হয়। স্মারকলিপি দেওয়া হয়। বনগাঁ শহর যুব তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি পল্লব মিত্র বলেন, ‘‘ভোটের ফল ঘোষণার দিন বিজেপির লোকজন আমাদের কর্মীদের মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। গুলি চালানো হয়। আরও কয়েকটি এলাকায় কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন। পুলিশকে অভিযোগ করা হলেও পদক্ষেপ করেনি। তারই প্রতিবাদে এ দিন থানায় স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।’’ পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ করা হচ্ছে। অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।
বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক দেবদাস মণ্ডল বলেন, ‘‘মহকুমা জুড়ে তৃণমূলের লোকজনই আমাদের কর্মীদের উপরে হামলা করছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করছে।’’ বিজেপি সূত্রে জানানো হয়েছে, গোপালনগরের দমদমা এবং মেঠোপাড়ায় তাদের কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন।
এ দিকে, আমডাঙা বিধানসভা এলাকায় মঙ্গলবার রাতে একাধিক জায়গায় বোমাবাজি হয়েছে বলে অভিযোগ। মানুষ আতঙ্কিত। তৃণমূল ও আইএসএফ কর্মীদের মধ্যে ছোটখাটো গোলমালের ঘটনা ঘটেছে।
দেগঙ্গায় বহু আইএসএফ এবং বিজেপি কর্মী-সমর্থক ঘরছাড়া বলে অভিযোগ দলের। অনেকের বাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি ভেড়ি লুটের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। রেশন কার্ড ও রেশন সামগ্রী কেড়ে নেওয়ারও অভিযোগ করেছে বিজেপি-আইএসএফ। দেগঙ্গা বিধানসভা কেন্দ্রের আইএসএফ প্রার্থী করিম আলি বলেন, ‘‘ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে আমাদের কর্মীদের মারধরের পাশাপাশি বাড়ি-গাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে। কলসুর, চাকলা, বেড়াচাঁপা ২, হাদিপুর, ঝিকরা সর্বত্র চলছে হিংসা। মহিলা এবং শিশুদেরও মারধর করা হচ্ছে। চাকলা ও নুরনগরে আমাদের সমর্থকদের রেশন কার্ড এবং রেশনে পাওয়া সামগ্রী কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’’ বিজেপির অভিযোগ, তাদের কর্মী-সমর্থকেরা রেশন তুলতে গেলে হুমকি দিয়ে রেশনের চাল-আটা কেড়ে নিচ্ছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।
বুধবার এই অভিযোগ পেয়ে নুরনগর পঞ্চায়েতের গোবিন্দপুর বটতলায় একটি রেশন ডিলারের দোকানে পুলিশ যায়। রাজ্য তৃণমূল যুব সাধারণ সম্পাদক বাদল মিত্র বলেন, ‘‘মানুষ যে দলেরই হোন না কেন, তাঁদের উপরে কোনও রকম হিংসা বরদাস্ত করা হবে না। অবিলম্বে হিংসা বন্ধে পুলিশকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।’’