গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কেউ আঙুল তুলছেন ‘দক্ষিণপন্থী’ রাজনীতির দিকে। কেউ ঢোক গিলছেন। কেউ বলছেন, প্রশ্নটা তো ১০ বছর আগেও তোলা যেত! কেউ বলছেন, বদলাতে বলব। কিন্তু কেন তালিকা থেকে বাদ পড়ল মুসলিমদের উৎসবগুলোর নাম, তার সদুত্তর কোনও রাজনীতিকের কাছে নেই। সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের আক্রমণে ঝাঁঝ রয়েছে যথেষ্টই। কিন্তু বিজেপি, কংগ্রেস বা তৃণমূল— পরস্পরের দিকে আঙুল তুলতে গিয়েও থমকে যাচ্ছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের ব্যাখ্যা, মুসলিমদের উৎসবগুলি চান্দ্র মাস অনুযায়ী নির্ধারিত হয় বলেই এনপিআর ম্যানুয়ালে সেগুলি রেখে লাভ নেই।
২০২০ সালের জন্য জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর) তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। যাঁরা সেই কাজ করবেন, তাঁদের জন্য ম্যানুয়ালও প্রকাশিত হয়েছে। সেই ম্যানুয়ালই এখন বিতর্কের কেন্দ্রে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এনপিআর-এর তথ্য সংগ্রহ চলাকালীন যাঁরা নিজের জন্ম তারিখ বলতে পারবেন না, তাঁদের জন্মের সময় আন্দাজ করে নেওয়ার পদ্ধতি রয়েছে এনপিআর ম্যানুয়ালে। বিভিন্ন ধর্মের যে সব উৎসব-অনুষ্ঠান এ দেশে পালিত হয়, সেই সব উৎসব-অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে কোনটির কাছাকাছি সময়ে জন্ম হয়েছিল— এইটুকু তথ্য অনেকেই দিতে পারেন। তাই ওই সব উৎসবের তালিকাও ম্যানুয়ালে নথিভুক্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু সে তালিকায়, হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন-সহ সব ধর্মের উৎসবের নাম থাকলেও, মুসলিমদের কোনও উৎসবের নাম নেই।
আরও পড়ুন: মমতাকে ভয় পাবেন না: যোধপুরেও শাহের নিশানায় তৃণমূলনেত্রীই
কেন নেই? বামেদের দাবি, দেশে যে বিভাজন নীতির রমরমা, তার জেরেই এনপিআর ম্যানুয়াল থেকে বাদ পড়েছে মুসলিমদের উৎসব-অনুষ্ঠানের নাম। কিন্তু ২০২০ সালের এনপিআর ম্যানুয়ালেই যে প্রথম বার এই রকম ঘটল, তা কিন্তু নয়। ২০১০ সালে অর্থাৎ ইউপিএ জমানায় যে এনপিআর ম্যানুয়াল তৈরি হয়েছিল, তাতেও মুসলিমদের উৎসবগুলির নাম ছিল না।
ঠিক এই বিষয়টাকে উল্লেখ করেই জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে বিজেপি এবং পাল্টা প্রশ্ন তুলছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি তথা সাংসদ দিলীপ ঘোষের প্রশ্ন, ‘‘এনপিআর ম্যানুয়াল আগের বারও একই রকম ছিল। তখন তো প্রশ্ন তোলা হয়নি। হঠাৎ এত দিন পরে এসে কেন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে?’’ দিলীপের দাবি, প্রশ্নগুলোও তোলা হয় রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে। সেই কারণেই ইউপিএ জমানায় যখন এনপিআর ম্যানুয়াল থেকে বাদ পড়ে মুসলিমদের উৎসবগুলির নাম, তখন কেউ উচ্চবাচ্য করেন না, এনডিএ জমানায় হলেই হইচই শুরু হয়।
আরও পড়ুন: সিএএ-এনআরসির জেরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ভারত, মন্তব্য প্রাক্তন বিদেশ সচিবের
কংগ্রেস কী বলছে এ প্রসঙ্গে? রাজ্যসভার সাংসদ তথা পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কাছে সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। বিজেপির দিকে তিরটা ঘুরিয়ে দেবেন, সে উপায়ও খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই আর আক্রমণে না গিয়ে প্রদীপ বলছেন, ‘‘বাদ পড়া তো উচিত নয়! সব ধর্মের উৎসবের নামই থাকা উচিত। আগের বার কেন বাদ দিয়েছিল, এখনই বা কেন বাদ, বুঝতে পারছি না।’’
আর তৃণমূল এ বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আরও সাবধানী। সম্ভবত ২০১০ সালের কথা মাথায় রেখেই। সেই সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরিক ছিল তৃণমূল। সেই সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই তৃণমূল বিধায়ক তথা দলের অন্যতম মুখপাত্র পার্থ ভৌমিক বলছেন, ‘‘দু’বারই যখন একই ঘটনা ঘটেছে, তখন বিষয়টা নিয়ে রাজনৈতিক মন্তব্য করছি না। মনে হচ্ছে কোনও একটা ভুল হচ্ছে। সে ভুল সংশোধন করে নেওয়া উচিত।’’ তৃণমূল বিধায়কের কথায়, ‘‘আমরা বলব, এই ভুল শুধরে নিন। মুসলিমদের উৎসবগুলির নামও অন্তর্ভুক্ত করুন।’’
বামেদের অবস্থান কিন্তু এই রকম নরম নয়। সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘‘আমরা তো বার বারই বলছি, ভারতে এখন যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁদের রাজনীতিটাই হল বিভেদের রাজনীতি, অন্তর্ভুক্তির রাজনীতির ঠিক উল্টো।’’ সেলিমের কথায়, ‘‘কাউকে একটা বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রণ করা হল। যখন তিনি সেখানে গেলেন, তখন তাঁর সঙ্গে খুব শীতল ব্যবহার করা হল। বুঝিয়ে দেওয়া হল, তাঁকে কেউ পছন্দ করছেন না। তাঁর কি আর সেই বিয়েবাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করবে? মুসলিমদেরও সেই বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সুকৌশলে মুসলিমদের বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে যে, তাঁরা এ দেশে কাঙ্খিত নন। মুখে বলা হচ্ছে, ভারতীয় মুসলিমদের কোনও ভয় নেই। কিন্তু নানা ভাবে তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা অপাঙ্ক্তেয়।’’
সেলিম যে অভিযোগ করছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে সে অভিযোগ তাঁদের নতুন নয়। কিন্তু ইউপিএ তথা কংগ্রেস জমানাতেও এনপিআর ম্যানুয়ালের ছবিটা এই রকমই ছিল। তা হলে কি কংগ্রেসও বিভেদের রাজনীতি করছিল সে সময়? এই প্রশ্নের উত্তর আর বিশদ ভাবে দিতে চাননি সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য। জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে কংগ্রেস এবং বামেরা প্রায় হাত ধরাধরি করেই চলছে এখন। পশ্চিমবঙ্গে তো কংগ্রেস-সিপিএমে নির্বাচনী সমঝোতাও হচ্ছে। সিএএ বিরোধিতায় দু’দল এ রাজ্যে একসঙ্গে পথে নামছে। সুতরাং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলা সেলিমের পক্ষে এখন কঠিন। তাই স্বভাবসিদ্ধ বিশ্লেষণাত্মক উত্তর দেওয়ার পথ এড়িয়ে সেলিম বলছেন, ‘‘আমি কাউকেই আড়াল করছি না। শুধু বলতে পারি, আমরা বামপন্থীরা মানুষকে জুড়ে নেওয়ার রাজনীতি করি, দক্ষিণপন্থীরা ভেদাভেদের রাজনীতি করেন।’’
মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-ও এই এনপিআর ম্যানুয়ালের মধ্যে ভেদ-নীতি খুঁজে পাচ্ছে। সংগঠনের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রঞ্জিৎ শূরের ব্যাখ্যা, ‘‘সব ধর্মের উৎসবের কথা এনপিআর ম্যানুয়ালে থাকলেও মুসলিমদের কোনও উৎসব বা রীতির কথা নেই কেন? কারণ যে মুসলিমরা জন্মের তারিখ বলতে পারবেন না, তাঁদের জন্য অন্য কোনও ব্যবস্থা আর রইল না।’’ মুসলিমদের এই ভাবে বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে রঞ্জিৎ শূরের দাবি।
এনপিআর ম্যানুয়াল এই ভাবে তৈরি হল কেন? এত বিতর্কের মাঝেও কিন্তু আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি সরকার। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে একটি ব্যাখ্যার কথা জানা গিয়েছে। তা হল, চান্দ্র মাস অনুযায়ী হিসেব রাখার অসুবিধা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা। হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ বা জৈনদের উৎসবের তারিখ বা তিথি সৌর মাস অনুযায়ী হিসেব করা হয়। ভারত সরকার যে ক্যালেন্ডার প্রচলিত, সেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারেও সৌর মাস বা সৌর বছরের হিসেবই থাকে। কিন্তু মুসলিমদের নানা ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানের হিসেব রাখা হয় চান্দ্র মাস অনুযায়ী। ফলে উৎসবের সময় প্রতি বছরই এগিয়ে বা পিছিয়ে যায়। অর্থাৎ এ বছরে যে সময়ে কোনও একটি উৎসব হল, দু’তিন বছর পরে সেই উৎসবের সময়টা তার চেয়ে দু’তিন মাস এগিয়ে বা পিছিয়ে যায়— এমন নজিরও রয়েছে। তাই মুসলিমদের উৎসবগুলিকে সূচক হিসেবে ধরে জন্মের মাস হিসেব করা একটু কঠিন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের ব্যাখ্যা এই রকমই।
কিন্তু সে ব্যাখ্যা অনেকেই মানতে রাজি নন। এ প্রসঙ্গেও সুর সবচেয়ে চড়া বামেদেরই। সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘ব্যাখ্যা একটা দিতে হয়, তাই কিছু একটা বলে দিল। এই ব্যাখ্যা কোনও ব্যাখ্যাই নয়।’’ তন্ময়ের কথায়, ‘‘কেউ যাতে নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় না ভাবেন, তা নিশ্চিত করব বলে যদি আমি সিদ্ধান্ত নিই, তা হলে আমি নিশ্চয়ই তার ব্যবস্থা করতে পারি। সরকারি ছুটির ক্যালেন্ডারে ঈদের যে তারিখ লেখা থাকে, অনেক বছরই তো সেই তারিখে না হয় তার পরের দিন ঈদ হয়। সরকার বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে ছুটির তারিখ বদলে দেয়। এ ক্ষেত্রেও তেমন কোনও ব্যবস্থা চাইলেই রাখা যেত।’’