পায়ে পায়ে: ২৮ ফেব্রুয়ারি বাম-কংগ্রেসের যৌথ ব্রিগেড সমাবেশ।
গণনাট্য সঙ্ঘের কর্মীরা গাইছেন ‘শহিদের খুনে রাঙা পথে দেখো হায়নার আনাগোনা...’। বামেদের ব্রিগেড সমাবেশ মানেই এই ধরনের গানের অনুষঙ্গ বাংলা দেখে আসছে বছরের পর বছর। মুখ বদলেছে, কণ্ঠ বদলেছে, কিন্তু গানের গৎ বদলায়নি। এ বার সেই ব্রিগেড সমাবেশের প্রচারেই এলোমেলো হাওয়ার মতো ঢুকে পড়ল ‘টুম্পা সোনা’! যা একটি বাংলা আধুনিক জনপ্রিয় গানের রাজনৈতিক প্যারডি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বেরোনো মাত্র গান ভাইরাল, সিপিএমের বিভিন্ন নেতা-কর্মীও শেয়ার করেছেন কার্টুন-নির্ভর চিত্রনাট্যের উপরে তৈরি অডিয়ো-ভিজ্যুয়াল ক্লিপটি। কিন্তু সমালোচকেরা সরব হয়েছেন, সিপিএমের সংস্কৃতি তা হলে উচ্ছন্নে গেল?
তৃণমূল এবং বিজেপিকে ভোট দিয়ে, বিশ্বাস করে মানুষ প্রতারিত হয়েছেন— বামেদের এই রাজনৈতিক বক্তব্যের আধারের উপরেই নির্মিত ওই প্যারডিতে ডাক দেওয়া হয়েছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড ভরিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখার শুরু হোক। ব্যঙ্গাত্মক এই গানের রচয়িতা রাহুল পাল, যন্ত্রানুষঙ্গ এবং কণ্ঠে নীলাব্জ অধিকারী। গানের মধ্যে বলা আছে, ‘পিসির টালির চালের মালই পদ্মের জালে’, বলা আছে ‘মোদী-দিদি সব ভোগে যাক, টুম্পা... ’। সমালোচকদের মতে, এই ধরনের শব্দ ব্যবহার অপসংস্কৃতিকেই প্রশ্রয় দেয়। বামেরা রাজনৈতিক প্রচারে যে ধরনের গান-কবিতা ব্যবহার করে থাকে, সেই সংস্কৃতির সঙ্গেও এমন লাইন খাপ খায় না বলে তাঁরা মনে করছেন। প্রতিদিন সভা-সমাবেশে যে বিজেপি ও তৃণমূলের তরজা প্রায় খেউড়ের চেহারা নিয়েছে, তারাও এই প্যারডিকে হাতিয়ার করে সিপিএমকে বিঁধতে চাইছে না। সিপিএম বলছে, আরও বেশি মানুষের কাছে ডাক পৌঁছতে এই গান চটুল প্যারডিই। এটা গণসঙ্গীতের বিকল্প নয়, বরং প্রচারে সংযোজন।
রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর অভিমত, ‘‘সিপিএমের রাজনৈতিক দৈন্য এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ব্রিগেড সমাবেশে লোক ডাকার জন্য তাদের বিতর্কিত টুম্পার গানকে পণ্য করতে হচ্ছে। এ ধরনের অশোভন শব্দ ব্যবহার সিপিএমের সঙ্গে মানানসই। প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর উদ্যোগে ‘হোপ ৮৬’ অনুষ্ঠানের সময় সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতির প্রশ্ন তুলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজেকে চটুল মনোরঞ্জনকারী ওই অনুষ্ঠান থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। আজ আবার ‘ভোগে যাবে’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সিপিএম বোঝাল বুদ্ধবাবুরা খারিজ, তারা তাদের পুরনো পথেই আছে।’’ রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘সিপিএম এত কাল একটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রাখত। কিন্তু এখন অপ্রাসঙ্গিক এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে টুম্পা সোনাকে আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে তাদের। ২০১১ সালে সৌগত রায় বলেছিলেন, সিপিএম মায়ের ভোগে গেছে। তখন ওই শব্দ ব্যবহারের জন্য সিপিএম তাঁকে আক্রমণ করেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সিপিএমকে সেই তৃণমূলের সংস্কৃতিই গ্রাস করেছে।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী পাল্টা বলছেন, ‘‘কাউকে চোখ না রাঙিয়ে আমাদের অল্পবয়সি ছেলেরা একটা প্যারডি করেছে, তাতে আমরা খুশিই হয়েছি। নির্মল আনন্দেই দেখতে হবে এটা। কার্টুন-প্যারডি সংস্কৃতির একটা আঙ্গিক। বাংলায় আগে দেওয়ালে কার্টুন হত, মানানসই ছড়া থাকত। কার্টুন-প্যারডিতে যে ভাবে বলা হয়, সে ভাবে আমরা নিশ্চয়ই বক্তৃতা করি না! যাঁদের গায়ে লেগেছে, তাঁরাই একটা বিতর্ক খাড়া করছেন!’’
প্রদেশ কংগ্রেস নেতা অমিতাভ চক্রবর্তীরও বক্তব্য, ‘‘প্রচারের কৌশল হিসেবে তরুণ প্রজন্ম নানা উপায় বার করে চলেছে। এই রকম একটা প্যারডি হয়েছে বলে সংস্কৃতির বিপর্যয় ঘটেছে, মনে করছি না।’’
হেমাঙ্গ বিশ্বাস আর্কাইভের কাজে জড়িত গবেষক, লেখক রঙিলী বিশ্বাসের মতে, ‘‘আইপিটিএ-র শুরুর সময়ের (মানে ’৪০-এর দশক) সঙ্গে এখনকার তুলনা করা একটু কঠিন। তখনকার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি যে আঙ্গিক বা ভাষা (ডিকশন) ব্যবহার করতেন একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে, তার সঙ্গে এ সময়ের কোনও তুলনা আসলে চলে না। এটা ভালো খারাপের ব্যাপার নয়। রাজনৈতিক ভাষা বা আঙ্গিক সহস্র কারণে পালটে গিয়েছে।’’ ‘টুম্পা’ প্যারডি প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘‘রসিকতাকে এক ধরনের গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে নিয়ে আসাটা মনোযোগ দাবি করছে।’’
কার্টুন, পোস্টার, ছোট দৈর্ঘ্যের অণু-ছবি— নানা রকম আঙ্গিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্রিগেডের প্রচারে নেমেছে বামেরা। আপাতত সব ছাপিয়ে বিতর্কে এবং প্রচারে প্রথম ‘টুম্পা সোনা’ই!