শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে এখন জল্পনা জোরদার। জল্পনার কারণ তাঁর এবং তৃণমূলের মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা দূরত্ব। দল এবং তিনি— উভয় তরফ থেকেই গত বেশ কিছুদিন ধরে এই দূরত্ব বৃদ্ধির স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে কিছু বিষয়ে শুভেন্দুর নীরবতা এবং তার সঙ্গে কিছু বিষয়ে ‘ইঙ্গিতবাহী’ মন্তব্য তাঁর দল ছাড়ার জল্পনায় ইন্ধন জুগিয়েছে।
প্রশ্ন ঘুরছে, তিনি কি এ বছরই দল ছাড়ছেন? অনেকে বলছেন, ভাইফোঁটার পর দল ছেড়ে দিতে পারেন শুভেন্দু। দল ছাড়লে তিনি কি একইসঙ্গে মন্ত্রিত্ব ছাড়বেন? তৃণমূল ছাড়লে তিনি কি অন্য কোনও দলে যোগ দেবেন, নাকি নিজে নতুন দল বা মঞ্চ গড়ে আসন্ন বিধানসভা ভোটে নির্বাচনী সমঝোতায় যাবেন? নাকি সব কিছুর শেষে তিনি ‘তৃণমূলের সুভাষ চক্রবর্তী’ হবেন? এক সময় সুভাষের সিপিএম ছাড়া সময়ের অপেক্ষা বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি দল ছাড়েননি। সাবধানী কিন্তু ইঙ্গিতবাহী নানা মন্তব্যের বাইরে শুভেন্দু এখনও পর্যন্ত দলের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলেননি। কিন্তু একটা বড় সময় ধরে প্রকাশ্যে দল এবং দলনেত্রীর নাম তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে না বললেই হয়।
শিশির-শুভেন্দুদের অধিকারী পরিবারের যে নিজস্ব সাংগঠনিক দাপট রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরে, তা তৃণমূলে বিরল। শুভেন্দুর উত্থানের নেপথ্যে তাঁর নিজস্ব দক্ষতা এবং ক্যারিশমা যেমন বড় ফ্যাক্টর, তেমনই রয়েছে বাবা শিশির অধিকারীর তৈরি করে রাখা জমিও।
শিশির এবং গায়ত্রী অধিকারীর মেজ ছেলে শুভেন্দুর জন্ম ১৯৭০ সালের ১৫ ডিসেম্বর। শিশির তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার প্রভাবশালী কংগ্রেসনেতা ছিলেন। সাতের দশকে তিনি কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান হন। তার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে অধিকারী পরিবারের হাতেই রয়েছে কাঁথি।
ছোটবেলায় প্রতিদিন নিয়ম করে রামকৃষ্ণ মিশনে যেতেন শুভেন্দু। বাড়ির খাবারের চেয়ে বেশি পছন্দের ছিল মিশনের ভোগ। শিশিরের আশঙ্কা ছিল, তাঁর এই ছেলে কোনও দিন সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে যেতে পারেন।
১৯৮২ সালে শিশির দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ক হন। কিন্তু ১৯৮৭ সালের বিধানসভা ভোটে টিকিট না পেয়ে তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বিরুদ্ধে তোপ দেগে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়ান। হারিয়ে দেন কংগ্রেসপ্রার্থীকে।
বাড়ির অদূরে কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজে আটের দশকের শেষপর্বে ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি শুভেন্দুর। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদের হয়ে। যদিও শুভেন্দুর সে সময়কার বন্ধুদের অনেকেই ছিলেন সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর সঙ্গে।
কাঁথি কলেজে এসএফআই তেমন শক্তিশালী ছিল না। মূল লড়াই হত একদিকে প্রিয়রঞ্জন অন্যদিকে গনি খান-সোমেন মিত্রের অনুগামী ছাত্র পরিষদের দুই গোষ্ঠীতে। শেষ পর্যন্ত শুভেন্দুর নেতৃত্বেই কলেজে সোমেন-গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৫ সালে কাঁথি পুরসভা ভোটে কংগ্রেসের টিকিটে জিতে কাউন্সিলর হন শুভেন্দু। পুর এলাকা জুড়ে জনসংযোগ অভিযানে নজর কাড়েন।
বাবার হাত ধরে নানা সমবায় সংস্থার কাজে জড়িত হয়েছিলেন। এখনও রয়েছেন পুরোমাত্রায়। তবে কাঁথি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক, কাঁথি কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, বিদ্যাসাগর কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান পদে থাকলেও বেতন বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা নেন না।
১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল গড়েন। সেই দলে প্রথমে সামিল হননি শিশির-শুভেন্দু। কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে লড়ে শিশির তৃতীয় স্থান পান। এর কিছু দিন পরে তাঁরা তৃণমূলে যোগ দেন।
১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে কাঁথি কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী নীতীশ সেনগুপ্ত জিতেছিলেন। সেই জয়ে বড় ভূমিকা ছিল শিশির-শুভেন্দুর।
২০০১ সালে শিশিরকে দক্ষিণ কাঁথি এবং শুভেন্দুকে মুগবেড়িয়া বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেন মমতা। শিশির দু’দশক পরে ফের বিধায়ক হলেও বামফ্রন্ট প্রার্থী এবং তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দের কাছে হেরে যান শুভেন্দু।
২০০২ সালে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ভেঙে গঠিত হয় পূর্ব মেদিনীপুর। কাঁথিকে নয়া জেলা সদর হিসেবে ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন হয়। শেষ পর্যন্ত কাঁথির বদলে সদর হয় তমলুক। শুভেন্দুর নেতৃত্বে কাঁথির মানুষ তা মেনে নেন।
২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে তমলুক কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হন শুভেন্দু। কিন্তু সিপিএম সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের কাছে হেরে যান।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে দক্ষিণ কাঁথি কেন্দ্রটি মেজ ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে শিশির এগরায় প্রার্থী হন। জেতেন দু’জনেই। প্রথম বার বিধায়ক হন শুভেন্দু।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের একটি বিতর্কিত নোটিস ঘিরে নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলন দানা বাঁধে। বিরোধীদের যৌথ মঞ্চ ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র পতাকায় প্রতিরোধ শুরু হলেও ধীরে ধীরে তৃণমূল বিধায়ক শুভেন্দুই ‘আন্দোলনের মুখ’ হয়ে ওঠেন।
২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে শুভেন্দুর নেতৃত্বে সিপিএমকে হারিয়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ দখল করে তৃণমূল। হুগলি নদীর ওপারে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেও প্রচারে অংশ নেন তিনি। সেবার রাজ্যে ওই দু’টি জেলাই জিতেছিল তৃণমূল।
২০০৮ সালেই মদন মিত্রকে সরিয়ে শুভেন্দুকে যুব তৃণমূলের সভাপতি করেন মমতা।
২০০৯-এর লোকসভা ভোটে তমলুকে লক্ষ্মণকে হারিয়ে প্রথম বার সাংসদ হন শুভেন্দু। কাঁথি কেন্দ্রে জিতে প্রথম সাংসদ হন শিশিরও। মনমোহন সরকারে প্রতিমন্ত্রী হন শিশির। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের নেতা শুভেন্দু হন শিল্প বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য।
সে বার লোকসভা ভোটের কয়েক মাস আগে নন্দীগ্রাম বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পরে দলের প্রথম প্রার্থী হিসেবে তমলুকে শুভেন্দুর নাম ঘোষণা করেছিলেন মমতা। সে বছর কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান পদেও বাবার স্থলাভিষিক্ত হন শুভেন্দু।
২০১১-র বিধানসভা ভোটে রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। পূর্ব মেদিনীপুরের ১৬টি বিধানসভা কেন্দ্রের সব ক’টিতেই জয়ী হয় তৃণমূল। কাঁথি দক্ষিণের বিধায়ক হন শুভেন্দুর সেজ ভাই দিব্যেন্দু। ছোট ভাই সৌমেন্দু কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান হন।
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ফের পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি এবং তমলুক কেন্দ্রে জেতেন শিশির-শুভেন্দু। তবে যুব তৃণমূলের সভাপতি পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে সৌমিত্র খাঁকে বসানো হয়। যদিও তার কিছুদিন আগেই মমতা ‘যুবা’ নামে সমান্তরাল যুব সংগঠন গড়ে ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দেন। সেই প্রথম ‘নেত্রীর বিরুদ্ধে শুভেন্দুর ক্ষোভ’ নিয়ে খবর সামনে আসে।
২০১৫-য় শুভেন্দুকে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেন মমতা। পরবর্তী কালে আরও একাধিক জেলার দায়িত্ব পান শুভেন্দু। সে বছর পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের জনসভায় যুব তৃণমূলের সভাপতি অভিষেককে এক যুবক চড় মারায় জল্পনা তৈরি হয়। শুভেন্দু ওই সভায় গরহাজির ছিলেন।
২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে জিতে শুভেন্দুর মমতা মন্ত্রিসভায় প্রবেশ। ভোটের আগে ‘নারদ’ গোপন ক্যামেরা অভিযানে শুভেন্দুর ভিডিয়ো ফুটেজ সামনে আসায় বিতর্ক হয়। জেলায় তিনটি বিধানসভা আসনে তৃণমূলের হার নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
নারদ-কাণ্ডের জেরে শুভেন্দু প্রথম ইডি-র জেরার মুখোমুখি হন ২০১৭-র সেপ্টেম্বরে। সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে।
২০১৯ লোকসভা ভোটে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার তৃণমূলের ফল ভাল না হওয়ায় পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব থেকে শুভেন্দুকে সরানো হয়।
২০২০-র অগস্টে তৃণমূলের রাজ্য সরকারি কর্মী সংগঠনের দায়িত্ব থেকে সরানো হয় শুভেন্দুকে। দলীয় পর্যবেক্ষকের পদটাইঅ তুলে দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে, শুভেন্দু ছিলেন একাধিক জেলার পর্যবেক্ষক।
২০২০-র সেপ্টেম্বরে তমলুকে প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্মরণসভায় দল এবং দলনেত্রীর নাম মুখে আনেননি শুভেন্দু। সেই শুরু নতুন জল্পনার।
সেই জল্পনা ক্রমশ বাড়ছে। অনুগামীদের নিয়ে জেলায় পরপর দলীয় ব্যানারহীন কর্মসূচি করে চলেছেন শুভেন্দু। বিভিন্ন ‘তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবাহী’ মন্তব্য করছেন। যা থেকে রাজ্য রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, দল এবং রাজনীতিতে স্পষ্ট বার্তা পাঠাতে চাইছেন তিনি। পাশাপাশিই, তাঁর অনুগামীরাও বার্তাবাহী পোস্টার, ব্যানার দিচ্ছেন জেলার বিভিন্ন এলাকায়। সোমবার কলকাতায় নিজের দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেছেন পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু। ফলে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে জল্পনা আরও বাড়ছে।