হেস্টিংস ক্রসিং-এ তখন পুলিশের ব্যারিকেডে উঠে পড়েছেন বিজেপি নেতা রাকেশ সিংহ। -নিজস্ব চিত্র।
বিজেপির কর্মী সমর্থকদের গাড়ি তো দূরের কথা, মিডিয়ার গাড়িও তখন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না হেস্টিংসের দিকে। ধর্মতলার দিক থেকে হোক বা প্রিন্সেপ ঘাট ছুঁয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে, কোনও পথেই নিস্তার নেই। দফায় দফায় পুলিশি বাধার মুখে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে অবশেষে হাঁটা শুরু করলাম সঙ্গী চিত্রসাংবাদিককে নিয়ে। ওই হাঁটা যে পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় দৌড়ঝাঁপ, লাঠি, জলকামান, মাথার উপর দিয়ে উড়তে থাকা ইটের টুকরো আর অ্যাম্বুল্যান্সের ছোটাছুটির মধ্যে কাটবে, সেটা তখনও বোঝা যাচ্ছিল না।
হেস্টিংস মোড়ের অদূরেই স্থানীয় বিজেপি দফতর। সামনের রাস্তায় জমায়েত শুরু করেছিলেন দক্ষিণ কলকাতা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন অংশ থেকে আসা কর্মীরা। গাড়ি চলাচলের জন্য খিদিরপুরের দিকের রাস্তা ছাড়া কোনওটাই তখন খোলা নেই। তাই মিছিল শুরুর আনুষ্ঠানিক সময় ১২টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা ছন্নছাড়া ছিল গেরুয়া শিবির। এসএসকেএমের দিক থেকে একে একে মিছিল ঢুকছিল। আর খিদিরপুরের দিক থেকে পর পর ঢুকছিল মিনি ট্রাক-পিক আপ ভ্যান।
মাইকে স্লোগান চলছে, মিছিল শুরুর প্রস্তুতি তুঙ্গে, গেরুয়া পতাকায় এলাকা ছয়লাপ। কিন্তু সে সব কিছুই নজর কাড়ছে না। কারণ, গোটা এলাকায় যাবতীয় নজর কেড়ে নিচ্ছে পুলিশি বন্দোবস্ত। রাস্তায়, কিয়স্কে, মোড়ে, গলিতে, উড়ালপুলে, ব্রিজের তলায়, ব্যারিকেডে, জলকামানে— সর্বত্র পুলিশ। খাকি পুলিশ, সাদা পুলিশ, জংলা পুলিশ, রোবো পুলিশ। যেন পুলিশের মেলা। একদল পুলিশ রাস্তা আটকাচ্ছে। একদল লাঠি-ঢাল-শিরস্ত্রাণ-বর্মে সেজে মহাকাব্যিক সৈন্যদলের ভঙ্গিতে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। একদল টহলে। কেউ কেউ আবার উড়ালপুলের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছেন।
পুলিশের সঙ্গে বচসায় বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়।-নিজস্ব চিত্র।
পৌনে ১টা নাগাদ বিজেপি দফতর থেকে নেতারা বেরিয়ে আসতেই দ্রুত বদলাতে শুরু করল আবহ। সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়, রাজ্যসভার সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত, রাজ্য সহ-সভাপতি তথা ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহ, আরেক সহ-সভাপতি তথা প্রাক্তন পুলিশকর্তা ভারতী ঘোষ, রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, রাজ্য সম্পাদক তথা রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত, শিশির বাজোরিয়া, শঙ্কুদেব পন্ডা, রাকেশ সিংহ— নেতৃত্বের বিশাল বহর এবং তাঁদের ঘিরে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতা দেখে মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে উঠল গেরুয়া জনতা। আপাতদৃষ্টিতে এতক্ষণ যে ভিড়কে ছন্নছাড়া মনে হচ্ছিল, সেই ভিড়ই দ্রুত জমাট বেঁধে প্রায় গর্জনের ভঙ্গি শুরু করে দিল।
আরও পড়ুন: ইটবৃষ্টি-বোমাবাজি, উদ্ধার হল পিস্তল, বিজেপির মিছিল ঘিরে ধুন্ধুমার
ইতিউতি বেঁধে রাখা মাইকে স্লোগান চলছিল অনেকক্ষণ ধরেই। নেতারা সামনে আসতেই মাইকের আওয়াজ ছাপিয়ে গেল মিছিলের স্লোগান। নবান্নে যাওয়ার রাস্তার দিকে এগোতে শুরু করল মিছিল। কিন্তু খুব বেশি হলে ১৫০ মিটার। হেস্টিংস মোড় থেকে সামান্য এগিয়ে যে রাস্তা দ্বিতীয় হুগলি সেতুর দিকে উড়াল দিয়েছে, সেই রাস্তায় যাতে পা-ই না রাখতে পারেন বিজেপির নেতাকর্মীরা, তা আগে থেকেই নিশ্চিত করে রেখেছিল পুলিশ। রাস্তার মুখে শালবল্লার বিরাট ব্যারিকেড। তার গায়ে আবার লোহার গ্রিল আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখা। ব্যারিকেডের সামনে বাহিনী, পিছনে বাহিনী। আর তার পিছনে প্রস্তুত জলকামান। অতএব ১৫০ মিটার এগিয়েই মিছিল ধাক্কা খেল ব্যারিকেডে। বিজেপি নেতাদের সঙ্গে পুলিশের বচসা শুরু হল। পুলিশ রাস্তা খুলতে রাজি না হওয়ায় লকেট, রাকেশরা দলবল নিয়ে উঠে পড়লেন ব্যারিকেডে। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে লাঠি চালাতে শুরু করল। মাথায় আঘাত পেয়ে ব্যারিকেড থেকে পড়ে গেলেন রাকেশ। উত্তাল হয়ে উঠল জনতা।
আরও পড়ুন: জলকামান ছুঁতে পারল না দিলীপকে, ১ ঘণ্টার কর্মসূচি হল ‘রীতি’ মেনেই
ডিসি পোর্ট সৈয়দ ওয়াকার রাজার নেতৃত্বে পুলিশ প্রস্তুতই ছিল। তিন দিক থেকে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গেল বাহিনী। কয়েক মিনিটের মধ্যে চার ভাগে ভেঙে ছড়িয়ে গেল ভিড়টা। একটা অংশ ব্যারিকেডের সামনেই অবস্থান শুরু করল। মিছিলের বাকি তিনটে টুকরো তিন রাস্তায়। ওই তিন রাস্তা অবরোধমুক্ত করতে পুলিশ কখনও তাড়া করে গেল। কখনও সুযোগ পেয়েই পুলিশের দিকে আবার পাল্টা তেড়ে এলেন বিজেপি কর্মীরা। সে টানাপড়েন ঘণ্টাখানেক ধরে চলতে থাকল। আর ব্যারিকেডের সামনের অংশ ফাঁকা করতে জলকামানের মুখ খুলে দিল পুলিশ।
বিজেপির মিছিল ভাঙতে পুলিশের জলকামান। -নিজস্ব চিত্র।
হেস্টিংস মোড় বা উড়ালপুলে ওঠার মুখ পুলিশ দ্রুত ফাঁকা করে দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এলাকা তখনও অবরুদ্ধই। কেন লাঠি চালানো হল? কেন রাকেশের মাথা ফাটল? পুলিশের কাছে তখন জবাব চাইছেন অর্জুন, লকেট, ভারতীরা। পুলিশ বলছে, ‘‘জমায়েত থেকে ইট ছোড়া হয়েছে। তাই লাঠি চালানো ছাড়া উপায় ছিল না।’’ কিন্তু বিজেপি নেতারা দাবি করছেন, কেউ একটা ইটও ছোড়েননি। পুলিশ ‘বিনা প্ররোচনায়’ প্রবল বলপ্রয়োগের রাস্তা নিয়েছে।
চোখে দেখে পুলিশের দাবি মিথ্যা বলে মনে হয়নি। হেস্টিংস উড়ালপুলের এক কোণ থেকে পুলিশের দিকে সত্যিই ইটপাথর উড়ে গিয়েছিল। জনতা ছত্রভঙ্গ হওয়ার পরে ইটের টুকরো রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু বিজেপির দাবি, ওই ইট বিজেপির কেউ ছোড়েনি। অর্জুন তো সরাসরি মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে বললেন, ‘‘ইট ছুড়েছে ববি হাকিমের লোকেরা এখানে গোলমাল পাকানোর জন্য ববি হাকিম লোক লাগিয়ে রেখেছে। ওর লোকেরাই ইট ছুড়ে পুলিশকে লাঠি চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।’’ তার পরে গলা আরও চড়িয়ে কর্মীদের উদ্দেশে, ‘‘কারা ইট ছুড়ছে লক্ষ্য রাখুন। সব ববি হাকিমের লোক। ইট ছুড়তে দেখলেই এখানে ফেলে পেটান।’’
এর পরে অবশ্য আর ইট পড়েনি।
অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাকেশ সিংহ। -নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: বিজেপির নবান্ন অভিযানে স্তব্ধ মধ্য কলকাতা, আটক অ্যাম্বুল্যান্সও
টানাপড়েন, দৌড়ঝাঁপ, চোখরাঙানি-পাল্টা চোখরাঙানিই সার। জলকামান-লাঠির মুখে দাঁড়িয়ে নবান্ন-পথের ব্যারিকেড শেষ পর্যন্ত ভাঙতে পারলেন না বিজেপি নেতারা। কিন্তু সহজে রণে ভঙ্গ দিতেও তাঁরা রাজি নন। অর্জুন-লকেট মিলে কর্মীদের ফের চৌরাস্তার মাঝখানে জড়ো করতে শুরু করলেন। মাইক টেনে নিয়ে কর্মীদের ধমকালেন অর্জুন, ‘‘আপনারা ভয় পাচ্ছেন কাকে? এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশকে? যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভয় পেয়ে নবান্ন বন্ধ করে দিয়েছেন, তাঁর পুলিশকে ভয় পেয়ে আপনারা সরে যাচ্ছেন!’’ সেখানেই না থেমে বললেন, ‘‘রাকেশ সিংহ ভয় পেয়েছেন? পুলিশ তো ওঁর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে! আপনারা ভয় পাচ্ছেন কেন?’’
আরও পড়ুন: লাদাখে চিনের ‘একতরফা আগ্রাসন’-এর সব তথ্য ওয়েবসাইট থেকে মুছল প্রতিরক্ষা মন্ত্রক
ছত্রভঙ্গ বিজেপি কর্মীরা অর্জুন-লকেটদের ডাকে ফের ফিরলেন চৌরাস্তায়। অবস্থান বিক্ষোভ শুরু হল। কৈলাস-সহ সব সিনিয়র নেতাই একে একে ভাষণ শুরু করলেন। কিন্তু ততক্ষণে নবান্ন অভিযানের অন্যান্য ‘হটস্পট’ থেকেও খবর পৌঁছতে শুরু করেছে হেস্টিংস চত্বরে। রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় হাসপাতালে। সায়ন্তন বসু, জ্যোতির্ময় মাহাতো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অরবিন্দ মেননকে মেরেছে পুলিশ। পর পর ‘দুঃসংবাদে’ মুষড়ে পড়ার পালা। ৩টে নাগাদ অবস্থান তুলে নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের বিরাট কনভয় হেস্টিংস চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে গেল হাসপাতালের দিকে। অসুস্থ নেতাদের দেখতে। হা-ক্লান্ত বিজেপি কর্মীরা বিধ্বস্ত অবস্থায় খুঁজতে শুরু করলেন, কোথায় রয়েছে গাড়িগুলো।
ছোটখাট-ছিপছিপে চেহারার আইপিএস সৈয়দ ওয়াকার রাজা হেলমেটটা খুলে হাতটা বুলিয়ে নিলেন মাথায়।