চক্রবর্তীর বাড়ি পাহারায় পুলিশ, অবাক পাড়া

তিনি কোনও ভিআইপি নন। কস্মিনকালে মন্ত্রী-সান্ত্রী ছিলেন না। আইএএস বা আইপিএস-ও নয়। তবু তাঁর বাড়িতে ‘অনভিপ্রেত’ লোকের (পড়ুন সাংবাদিকদের) আসা-যাওয়া ঠেকাতে মোতায়েন হয়েছে বন্দুকধারী পুলিশ! তাঁর নাম বিমলেন্দু চক্রবর্তী। গড়ফা থানা এলাকার যাদবগড় কলোনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৭
Share:

হালতুতে বিমলেন্দু চক্রবর্তীর বাড়ির সামনে বসেছে পুলিশ পিকেট। সোমবার। — নিজস্ব চিত্র।

তিনি কোনও ভিআইপি নন। কস্মিনকালে মন্ত্রী-সান্ত্রী ছিলেন না। আইএএস বা আইপিএস-ও নয়। তবু তাঁর বাড়িতে ‘অনভিপ্রেত’ লোকের (পড়ুন সাংবাদিকদের) আসা-যাওয়া ঠেকাতে মোতায়েন হয়েছে বন্দুকধারী পুলিশ! তাঁর নাম বিমলেন্দু চক্রবর্তী।

Advertisement

গড়ফা থানা এলাকার যাদবগড় কলোনি। সেখানেই অনেকটা জায়গা জুড়ে বিমলেন্দুর দোতলা বাড়ি। বাড়ির উল্টো দিকে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে চার জন পুলিশ। দু’জন সশস্ত্র উর্দিধারী, দু’জন সাদা পোশাকে। সোমবার বিকেলে বিমলেন্দুর বাড়ির দিকে এগোতেই হাঁ-হাঁ করে উঠলেন তাঁরা। ‘‘কোথায় যাবেন?’’ গন্তব্য শুনে তেতো মুখ করে এক অফিসার বলেন, ‘‘যাওয়া যাবে না। বারণ আছে। তা ছাড়া, বিমলেন্দুবাবু ঘরে নেইও।’’ বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে চাই, এটা শুনে তাঁর জবাব, ‘‘বাড়িতেও কেউ নেই।’’

কে এই বিমলেন্দু চক্রবর্তী? পড়শিরা অনেকে বললেন, তিনি বিভিন্ন সংস্থার হিসেব রাখার কাজ করেন। কেউ কেউ আবার জানেন, তিনি আয়কর অফিসে কাজ করেন। জীবনযাপনও রীতিমতো সাদামাঠা। এহেন বিমলেন্দুর বাড়ির সামনে আচমকা পুলিশ পাহারা বসে যাওয়ায় পড়শিরা হতবাক। আচমকা কী এমন হল যে রাতারাতি ভিআইপি হয়ে গেলেন বিমলেন্দু? তৃণমূল সূত্র বলছে, বিমলেন্দুই সেই ‘চক্রবর্তী’, তৃণমূলের আয়-ব্যয়ের হিসের প্রসঙ্গে যাঁর কথা সুব্রত বক্সীকে লিখেছিলেন মুকুল রায়। তৃণমূলের আয়-ব্যয়ের হিসেব চেয়ে সিবিআই তৎপর হয়ে ওঠার পরে গত ১৮ মার্চ দলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুলকে চিঠি লিখে যাবতীয় কাগজপত্র চেয়ে পাঠিয়েছিলেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত সুব্রত বক্সী। ওই চিঠির জবাবে ৩ এপ্রিল মুকুল লেখেন, ‘‘...আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, জনৈক শ্রী চক্রবর্তী দলের হিসাবপত্র সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় দেখভাল করেন। অতএব, যে সব কাগজপত্র আপনি চাইছেন, সে জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।’’

Advertisement

আয়কর দফতর ও নির্বাচন কমিশনে তৃণমূল যে অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তাতে অডিটর হিসেবে সই রয়েছে প্রাণকুমার চক্রবর্তীর। কিন্তু সপ্তাহখানেক আগে আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে রিজেন্ট পার্কের বাপুজিনগরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি অ্যালঝাইমার্স রোগে আক্রান্ত। গত চার বছর ধরে তিনি অডিটের কোনও কাজই করেননি বলে দাবি করেন প্রাণকুমারবাবুর র স্ত্রী কল্পনাদেবী, ছেলে সন্দীপন এবং পারিবারিক চিকিৎসক। তার আগেও তিনি কখনও তৃণমূলের অডিট করেনি বলে দাবি তাঁর পরিবারের।

এর পরেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে তাঁকে সামনে রেখে, তাঁর অফিসের প্যাড ব্যবহার করে কে ওই হিসেব দাখিল করছেন? এমনকী অসুস্থ প্রাণকুমার বাবুর বকলমে কেউ এক জন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইনস্টিটিউট থেকে তাঁর সদস্যপদ নবীকরণও করিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে। কে সেই ব্যক্তি?

সেই খোঁজ করতে গিয়েই উঠে আসে আর এক চক্রবর্তীর নাম। তৃণমূল মহলে যিনি ‘চক্রবর্তীদা’ নামেই পরিচিত। জানা গিয়েছে, এই চক্রবর্তীদার হাতেই তুলে দেওয়া হতো দলের যাবতীয় হিসেব-নিকেশের তথ্য। অডিটরের রিপোর্ট নিয়ে তিনি তা ফের এসে জমা দিতেন তৃণমূল অফিসে। প্রাণকুমার বাবু যদি অডিট না-করে থাকেন, তা হলে ব্যালান্স শিটে কাকে দিয়ে সই করাতেন ‘চক্রবর্তীদা’? এই প্রসঙ্গে উঠে আসে আর এক চক্রবর্তীর নাম। তিনিই তৃণমূলের আয়-ব্যয় অডিট করেছেন কি না জানতে তাঁকে ফোন এবং এসএমএস করা হয়, কিন্তু কোনও জবাব পাওয়া যায়নি।

এর পরেই বিমলেন্দুর বাড়ির সামনে বসে পুলিশ পাহারা। কেন? পুলিশ সূত্রের দাবি, গত শুক্রবার রাতে একটি বাংলা টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান বিমলেন্দুর খোঁজ করতে যান। তখন তিনি বাড়ি ছিলেন না। ওই দুই সাংবাদিক অপেক্ষা করতে থাকেন। সে খবর জানতে পেরে বাড়ি ফেরার আগেই বিমলেন্দু যোগাযোগ করেন ‘উপর মহলে’। সাধারণ কর্মীরা বিমলেন্দুকে সে ভাবে না চিনলেও দলের শীর্ষ স্তরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে বলে তৃণমূল সূত্রের দাবি। সেই স্তর থেকেই পুলিশের কাছে খবর পৌঁছয়। গড়ফা থানায় ডেকে নেওয়া হয় বিমলেন্দুকে। সেখানে তিনি লিখিত ভাবে জানান, তাঁর বাড়ির সামনে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যাক্তিরা সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাফেরা করছেন। এতে তিনি আতঙ্কিত এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এর পরে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসেন গড়ফা থানার ওসি নিজেই। বাড়ির সামনে বসে যায় পুলিশ পাহারা।

কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, প্রাক্তন আইএএস অফিসার দীপক ঘোষ। এ নিয়ে রবিবার গড়ফা থানায় একটি অভিযোগও দায়ের করেছেন তিনি। দীপকবাবুর বক্তব্য, সে দিন রাতে পুলিশি ঘেরাটোপে বিমলেন্দুবাবুর বাড়ি ফেরার গোটা ঘটনাটি তাঁর চোখের সামনে ঘটেছে। পুলিশ যে ভাবে বিমলেন্দুবাবুকে আড়াল করছে তার মধ্যে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে।

গড়ফা থানার অবশ্য দাবি, কোনও সাধারণ ব্যক্তিও যদি নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রহরা চান, তা হলে তাঁকে তা দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে পাহারার জন্য নির্দিষ্ট টাকা দিতে হয় তাঁকে। বিমলেন্দুও সেই ভাবেই পুলিশি পাহারা চেয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় টাকা দিয়েছেন। তবে এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার রাজীব মিশ্র। ওই এলাকার দায়িত্বে থাকা ডিসি (এসএসডি) সন্তোষ পাণ্ডে ফোনে বলেন, ‘‘আপনাকে আমি চিনি না। তা ছাড়া আপনি ফোন করলে আমি জানাতে বাধ্য নই যে পুলিশ কেন বিমলেন্দুবাবুর নিরাপত্তা বাড়িয়েছে।’’ যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে।

এ দিন বিকেলে বিমলেন্দুবাবুর বাড়ির সামনে পুলিশ যখন জানিয়েছিল যে বাড়িতে কেউ নেই, সেই সময়ে সেই বাড়ি থেকে চার কাপ চা থালায় সাজিয়ে নিয়ে এক যুবক বাইরে আসেন। তিনি জানান, তাঁর নাম বিকাশ। তিনি বিমলেন্দুবাবুর ছেলে। বাবা কোথায়? উত্তর আসে, ‘‘জানি না।’’ কখন ফিরবেন? উত্তর: ‘‘বলতে পারব না।’’ বাবা কী করেন? বিকাশ বলেন, ‘‘আমি কিছুই জানি না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement