জয়নগরের নিহত তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্কর। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ক্ষমতা দেখিয়ে অনেকেরই রুজিরুটিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন জয়নগরে নিহত তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্কর। যাঁরাই খুনের ঘটনায় জড়িত, তাঁরা সকলে শাসকদলের নেতার দাপটের ‘শিকার’ হয়েছেন অতীতে। ধৃতদের জেরা করে এবং স্থানীয়দের বয়ানে এই বিষয়গুলি উঠে আসায় তদন্তকারীদের একাংশ মনে করছেন, তৃণমূল নেতা খুনে যতটা না রাজনীতির যোগ রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি জোরালো হয়ে উঠছে ব্যক্তিগত আক্রোশের বিষয়টি। পুরনো রাগ থেকেই সইফুদ্দিনকে খুনের পরিকল্পনা করা হয়ে থাকতে পারে বলেই অনুমান তাঁদের। শুধু তা-ই নয়, গোটা পরিকল্পনায় প্রথম থেকেই বাড়ির এক সদস্য ‘শামিল’ ছিলেন বলে দাবি তদন্তকারীদের একাংশের।
সইফুদ্দিন খুনে মূল অভিযুক্ত আনিসুর রহমান লস্করকে বৃহস্পতিবারই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ধরা পড়েছেন কামালউদ্দিন ঢালি নামে এক অভিযুক্তও। তাঁদের দু’জনকে শুক্রবার বারুইপুর মহকুমা আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক তাঁদের ১১ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। শাহরুল শেখ নামেও এক জন ঘটনার দিন অর্থাৎ গত সোমবার গ্রেফতার হয়েছেন তৃণমূল নেতা খুনে। তিনিও এখন পুলিশ হেফাজতে। পুলিশ সূত্রে দাবি, ধৃতদের জেরা করে তদন্তকারীরা জেনেছেন, সর্বত্রই নিজের ক্ষমতা ফলাতেন সইফুদ্দিন। সম্প্রতি সেই ক্ষমতা আরও বাড়ে। নিজের ‘প্রভাবশালী’ পরিচয় দেখিয়ে অনেকেরই রুজি-রোজগারে ‘বাধা’ দিচ্ছিলেন সইফুদ্দিন। দিনে দিনে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল আনিসুর, কামালউদ্দিনদের দাপট। তা নিয়ে রাগ ছিল দু’জনের। শুধু তা-ই নয়, যাঁরা যাঁরা খুনের চক্রান্তে জড়িত, সইফুদ্দিনকে সরানোর লক্ষ্যে ব্যক্তিগত আক্রোশই তাঁদের কাছাকাছি এনেছিল। সকলে মিলেই সইফুদ্দিনকে খুনের পরিকল্পনা করেন।
সোমবার ভোরে বাড়ির কাছেই মসজিদে নমাজ পড়তে যাওয়ার সময়ে খুন হন সইফুদ্দিন। পালানোর পথে জনতার হাতে ধরা পড়ে যায় দু’জন। গণপ্রহারে মৃত্যু হয় সাহাবুদ্দিনের। অন্য জন শাহরুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই ঘটনার পরে নিকটবর্তী দলুয়াখাকি গ্রামে আনিসুর-সহ সিপিএমের কিছু কর্মী-সমর্থকের বাড়িতে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সইফুদ্দিনের পরিবারের তরফে আনিসুরের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের হয় থানায়। বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার পলাশচন্দ্র ঢালি জানান, আনিসুর এবং কামালউদ্দিন খুনে জড়িত ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে। কামালউদ্দিনও দলুয়াখাকি গ্রামেরই বাসিন্দা। এ ছাড়াও আরও কয়েকটি চরিত্র উঠে এসেছে তৃণমূল নেতার খুন-রহস্যে। ধৃত শাহরুল আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে নাসির ও ‘বড় ভাই’য়ের নাম নিয়েছিলেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘বড় ভাই’ হলেন আলাউদ্দিন সাপুই। যদিও ‘বড় ভাই’ সম্পর্কে এখন তাঁদের কাছে কোনও তথ্য নেই বলেই প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন পুলিশকর্তারা। বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার বৃহস্পতিবার বলেছেন, “শাহারুল এ রকম কারও নাম আমাদের কাছে বলেননি।”
তদন্তকারীদের একটি সূত্রের মত, প্রত্যেকের দায়িত্ব ভাগ করা ছিল। কেউ খুনের ছক কষেছেন, কেউ কেউ আবার সেই পরিকল্পনায় অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। সইফুদ্দিনের উপর দিনের পর দিন নজর রাখার দায়িত্ব ছিল শাহরুলের উপর। সাহাবুদ্দিনের দায়িত্ব ছিল তৃণমূল নেতাকে গুলি করার। সাহাবুদ্দিন ও শাহারুলকে খুনের বরাত দিয়েছিল নাসির এবং সেই ‘বড় ভাই’। আর এই গোটা পরিকল্পনার পিছনে ছিলেন আনিসুর ও কামালউদ্দিন। আর টাকাপয়সার জোগান দিয়ে সাহায্য করেছেন অন্তত দু’-তিন জন। তাঁদের মধ্যে এক সইফুদ্দিনের নিকটাত্মীয়ও রয়েছেন বলেও মনে করছেন তদন্তকারীদের ওই অংশ। এ ব্যাপারে অবশ্য পুলিশের তরফে সরকারি ভাবে কিছু জানানো হয়নি। পুলিশ সূত্রে খবর, বাকি জড়িতদের খোঁজে নানা জায়গায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। বারুইপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পার্থ ঘোষের নেতৃত্বে একটি দল গঠন করা হয়েছে। মোট ১১ জন পুলিশ অফিসার আছেন এই দলে। পুলিশ সূত্রে দাবি, পরিকল্পনামাফিকই হয়েছে গোটা অপারেশন। এর জন্য সব মিলিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছে।
এলাকায় প্রভাবশালী বলেই পরিচিত ছিলেন সইফুদ্দিন। স্থানীয়েরা জানান, একটা সময় আদালতে মুহুরির কাজ করতেন তিনি। সেই সূত্রেই জয়নগর থানায় যাতায়াত শুরু। থানার নানা কাজ করতেন সইফুদ্দিন। এ ভাবে বাম আমল থেকেই তাঁর পরিচিতি বাড়তে শুরু করে। তখন তিনি সিপিএমে। ২০১৮ সাল নাগাদ তৃণমূলে যোগ দেন। স্ত্রী বামনগাছির প্রধান নির্বাচিত হন। পুলিশ মহলে প্রভাব আরও বাড়ে। স্থানীয়দের দাবি, বহু মামলায় তাঁর মাধ্যমেই ‘সমঝোতা’ হত। থানার ডাক মাস্টার হিসাবেও পরিচিত হয়ে ওঠেন সইফুদ্দিন। বছর চারেক আগে জয়নগর থানা ভেঙে বকুলতলা থানা তৈরি হয়। সেখানেও তিনি প্রভাব বিস্তার করেন বলে স্থানীয়দের দাবি। অভিযোগ, কাঁচা টাকার আমদানি বাড়ে। বারুইপুর পূর্ব ও জয়নগর— দুই বিধানসভা এলাকাতেই বাড়ে তাঁর দাপট। রাজনৈতিক নেতা থেকে পুলিশ— সকলেরই সহায় ছিলেন তৃণমূল নেতা।
সইফুদ্দিন খুনে প্রাথমিক ভাবে রাজনীতির যোগের কথাই ভাবা হচ্ছিল। আনিসুর গ্রেফতার হওয়ার পর তৃণমূলের তরফে সেই দাবি আরও জোরালো ভাবে তোলা হয়। শাসকদলের সূত্রে দাবি, আনিসুর এলাকায় সিপিএম নেতা হিসাবে পরিচিত। কারও কারও দাবি, আনিসুর সিপিএমের ক্যাডার ছিলেন। এক সময়ে সিপিএমের এক বড় নেতার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে একাধিক দুষ্কর্ম করেছেন। জেলার বিভিন্ন এলাকায় খুনখারাপি, তোলাবাজিতে আনিসুর জড়িত বলে শাসকদলের একাংশের অভিযোগ। আরও দাবি, বহু বছর আগে কোনও ‘অপারেশনে’ গিয়ে আনিসুর গুলিও খান। তাঁর পেটে সেই দাগও রয়েছে।
২০১৮ সালের আগে পর্যন্ত বামনগাছি পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। পরে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতা জানান, গত পঞ্চায়েতে বামনগাছি এবং পাশের চালতাবেড়িয়া পঞ্চায়েত দখলে আনিসুরকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন সেই বড় নেতা। কিন্তু দু’টি পঞ্চায়েতে একটি আসনও মেলেনি সিপিএমের। তৃণমূলের বিরুদ্ধে বুথ দখল করে জেতার অভিযোগ ওঠে। সেই থেকেই সইফুদ্দিনের সঙ্গে আনিসুরের তিক্ততা বাড়ে বলে দাবি স্থানীয়দের একাংশের। প্রাথমিক ভাবে প্রশ্ন উঠেছিল, সেই তিক্ততার কারণেই কি খুন হন সইফুদ্দিন? তৃণমূলের কেউ কেউ দাবি করছেন, এমনও হতে পারে, আনিসুরকে কাজে লাগিয়ে খুন করিয়েছেন অন্য কেউ। বারুইপুর পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক বিভাস সর্দারের কথায়, “আনিসুরকে দিয়ে খুন করানো হয়েছে। করিয়েছেন সিপিএমের বড় নেতারা।” কিন্তু আনিসুরের সঙ্গে সিপিএমের কোনও যোগ নেই বলেই দাবি করেছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী। তাঁর দাবি, আনিসুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। আনিসুর সিপিএম দলের সদস্যও নন। একই কথা বলেছেন বারুইপুর পূর্বে কেন্দ্র থেকে গত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের হয়ে দাঁড়ানো স্বপন নস্করও। বামনগাছি পঞ্চায়েত এই বারুইপুর পূর্ব কেন্দ্রেরই অন্তর্গত।
তদন্তকারীদের সূত্রের বক্তব্য, আনিসুর গ্রেফতার হওয়ায় রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত আক্রোশ— এই দু’টি বিষয়ই ভীষণ ভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে খুনের নেপথ্যে মূল কারণ কোনটি, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শুক্রবারই বারুইপুর থানায় এসে আনিসুর ও কামালউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সিদ্ধনাথ গুপ্ত, ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) আকাশ মাঘারিয়া এবং বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার। এই ঘটনার তদন্তকারী দলের সদস্য বারুইপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এসডিপিও অতীশ বিশ্বাস এবং এই কেসের তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গেও কথা বলেন তাঁরা। পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘ধৃতদের ১১ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজত পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে তদন্তে অনেক অগ্রগতি হবে। এই ঘটনায় আরও ৭-৮ জন জড়িত আছেন।’’ ঘটনাচক্রে, শুক্রবার রাতেই জয়নগর থানার আইসি রাকেশ চট্টোপাধ্যায়কে সরানো হল। তাঁর জায়গায় দায়িত্বে আসছেন পার্থসারথি পাল।