এনআরএস-কাণ্ডে অভিযুক্তদের গ্রেফতার চেয়ে কলেজ স্কোয়ার থেকে এনআরএস পর্যন্ত ধিক্কার মিছিল। বৃহস্পতিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে স্কেচ আঁকানো যায়নি ঠিকই। কিন্তু তাঁরা পুলিশকে এ-ও বলেছিলেন, এনআরএসের হস্টেলে গত ১৬ নভেম্বর সকালে কোরপান শাহকে কারা পেটাচ্ছিলেন বা সেই সময়ে আশপাশে কারা ছিলেন, ফটোগ্রাফ দেখলে হয়তো তাঁরা চিনতে পারবেন।
কিন্তু কে দেবে ছবি?
আবাসিকদের নাম-ঠিকানা জোগাড় করতেই কালঘাম ছুটেছিল তদন্তকারীদের। এ বার তাঁদের অভিযোগ, এনআরএস কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবাসিকদের ছবি চাওয়া সত্ত্বেও তা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না সন্দেহভাজনদের। এ ব্যাপারে এনআরএসের অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তিনি ফোন ধরেননি। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, পুলিশ আবাসিকদের ছবি চেয়েছে বলে তিনি জানেন না।
লালবাজারের এক পুলিশকর্তা বৃহস্পতিবার বলেন, “হস্টেলের ক্যান্টিন কর্মী, নির্মাণকাজে নিযুক্ত শ্রমিক এবং অন্য কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে আমরা নিশ্চিত, ওই খুনের ঘটনায় কোন বহিরাগত জড়িত নয়।” পুলিশ সূত্রের খবর, প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, ১৬ তারিখ সকালে হস্টেলের চারতলায় এক যুবককে মারধর করা হচ্ছিল। সেই সময়ে ওই যুবককে (অর্থাৎ কোরপানকে) ঘিরে যাঁরা দাড়িয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই হস্টেলের আবাসিক বলে দাবি করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। স্বভাবতই আবাসিকদের ছবি না পেলে পুলিশের পক্ষে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা কার্যত অসম্ভব।
বস্তুত, খুনের মামলায় সন্দেহভাজনদের যে ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন, কোরপান হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে তা যে করা যাচ্ছে না, সে বিষয়ে গোড়া থেকেই ক্ষোভ জানিয়ে আসছেন তদন্তকারীরা। কোনও সন্দেহভাজনকে এখনও পর্যন্ত লালবাজারে নিয়ে গিয়ে জেরা করা যায়নি। নাম-ঠিকানা-ফোন নম্বর দেওয়া নিয়েও যথেষ্ট গড়িমসি হয়েছে। এ সবের জন্য স্বাস্থ্য দফতরের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন তদন্তকারীরা। যদিও একান্তে তাঁরা স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, ওপর মহলের নির্দেশ নেই বলেই তাঁদের হাত-পা বাঁধা। সেই সূত্রেই ঘুরেফিরে অভিযোগের তিরটা উঠছে তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেলের নেতাদের দিকে। তাঁরা ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বলেই এনআরএসের অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না বলে পুলিশ সূত্রেই দাবি করা হচ্ছে।
হবু চিকিৎসকদের যিনি প্রথম থেকেই আড়াল করে আসছেন বলে অভিযোগ, সেই বিধায়ক তথা তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেলের প্রধান নির্মল মাজি এ দিন বলেছেন, “আমরা সব সময় চাই দ্রুত প্রকৃত অপরাধী গ্রেফতার হোক।” তা হলে কর্তৃপক্ষ কেন আবাসিকদের নাম-ঠিকানা পুলিশকে জানাতে এত সময় নিলেন? কেন এখনও আবাসিকদের ছবি দেওয়া হচ্ছে না? নির্মলের জবাব, “এত দিন প্রচুর বহিরাগত ওই হস্টেলে জবরদস্তি থাকতেন। ফলে প্রকৃত আবাসিক খুঁজে তাঁদের ঠিকানা বের করে জানানো কঠিন কাজ ছিল।” কিন্তু ১৮ দিনেও কেন ছবি দেওয়া গেল না? নির্মলবাবুর জবাব, “সব দেওয়া হবে। এত তাড়াহুড়ো করলে হবে না। পুলিশ মোটেই ছবি চায়নি। সব আপনাদের সংবাদমাধ্যমের মনগড়া।”
স্বাস্থ্য ভবন বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা পরিষ্কার রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাতেই। সুশান্তবাবু এ দিন বলেন, “পুলিশ তো আবাসিক ছাত্রদের ছবির ব্যাপারে আমাকে কিছু জানায়নি। তা হলে আমি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাব কেন? পুলিশ আমাকে জানালে আমি না হয় অধ্যক্ষা মঞ্জুদেবীকে ছবি না-দেওয়ার জন্য বকাঝকা করতে পারতাম।” ঘটনাচক্রে, রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী একজনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা সত্ত্বেও দুই দফতরের মধ্যে এই সমন্বয়ের অভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
স্বভাবতই হতাশা বাড়ছে কোরপানের পরিবারের। বুধবারই অভিযুক্তদের গ্রেফতার চেয়ে আইন অমান্য করে পুলিশের হাতে হেনস্থা হয়েছেন প্রতিবন্ধীরা। বৃহস্পতিবার মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর উদ্যোগে কলেজ স্কোয়ার থেকে এনআরএস পর্যন্ত ধিক্কার মিছিল হয়। ইতিমধ্যেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছে এপিডিআর। হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলাও করেছে তারা। এ দিনের মিছিলে এপিডিআর সদস্যদের পাশাপাশি ছিলেন মানবাধিকার কর্মী তথা চিকিৎসক বিনায়ক সেন। তাঁর কথায়, “ঘটনাটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক এবং প্রশাসনের ভূমিকা দুর্ভাগ্যজনক।” মিছিলে সরকারি-বেসরকারি বহু চিকিৎসক ছাড়াও ছিলেন মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস ফেডারেশন ও বন্দি মুক্তি কমিটির সদস্যরা। প্রবীণ সরকারি চিকিৎসক হীরালাল কোনার থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন মৃণ্ময় সরকার, জিৎ, অনিরুদ্ধ প্রত্যেকের বক্তব্য প্রশাসনই চাইছে না সত্য সামনে আসুক। কারণ, হত্যাকাণ্ডের সমাধান হলে হয়তো আরও অনেক অজানা রহস্যের পর্দা ফাঁস হবে। তাতে শাসক গোষ্ঠীর অনেকে বিপদে পড়তে পারেন বলে এঁদের দাবি।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা অবশ্য এই মিছিলকে আমল দেননি। তাঁর কটাক্ষ, “ওঁরা হাঁটুন যত খুশি। এতে স্বাস্থ্য ভাল থাকবে।”