নিষিদ্ধ: চম্পাহাটির এক বাড়িতে চকলেট বোমা। নিজস্ব চিত্র।
সাত দিনও বাকি নেই কালীপুজোর। অথচ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার শব্দবাজির আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত চম্পাহাটিতে চকলেট বোমার ব্যবসায়ীর খোঁজ পেতেই ঘণ্টাখানেক লেগে যাচ্ছে! কারণ, হয় তাঁরা বাড়িতে নেই, নয়তো কারখানার শ্রমিকেরাই মালিকের বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকছেন। ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগেরই মোবাইল বন্ধ। তাঁদের ধারণা, পুলিশ ফোন ট্যাপ করছে। তাই জানতে পেরে যাচ্ছে, কোথায় বাজি লুকোনো আছে।
হারাল গ্রামের এক পরিচিত ব্যবসায়ীর দর্শন মিললেও তিনি কথা বলতে রাজি হলেন পরিচিতের মুদিখানার দোকানে বসেই। নিজের কারখানা থেকে দূরে সেই দোকানের পিছনের ছোট ঘরে নিয়ে গিয়ে বসলেন ব্যবসায়ী। এ বছর কি চকলেটের ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন? সতর্ক ব্যবসায়ীর নিচু স্বরে উত্তর, ‘‘পুলিশ আগে কারখানা-দোকানেতল্লাশি চালাত। চকলেট বোমা পেলে তুলে নিয়ে যেত। এখন পুলিশ সিবিআই-ইডি হয়ে গিয়েছে। ঘরে ঢুকে পড়ছে। খাটের তলা, রান্নাঘর, কিছুই ছাড়ছে না। কোথাও লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। চকলেট বোমা, আতশবাজি, বাজি তৈরির মশলা— সব নিয়ে চলে যাচ্ছে।’’
চকলেট বোমার অধিকাংশ ব্যবসায়ীই বাড়িছাড়া বলে শোনা যাচ্ছে। কারিগরেরা কারখানা ছেড়ে পরিচিত গৃহস্থের বাড়িতে বসেই চকলেট বোমা তৈরি করছেন। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে সে সব গোপন কথা। অথচ, রাজ্য জুড়ে চম্পাহাটির তৈরি চকলেট বোমার বিপুল চাহিদায় উত্তরবঙ্গ থেকেও ক্রেতা পৌঁছে যান সেখানে। তবে করোনার দাপটে গত দু’বছর বাজির ব্যবসা একেবারেই হয়নি। ব্যবসায়ীদের দাবি, মহাজনের থেকে ধার নেওয়া টাকার সুদও দিতে পারেননি তাঁরা। সুদের উপরে সুদ চড়ছে। এ বছর ব্যবসা ভাল হওয়ার আশা থাকলেও পুলিশের ধরপাকড়ে সে আশায় জল ঢালার আশঙ্কা করছেন ওই ব্যবসায়ীরা।
তবে ধরাবাঁধা ক্রেতাদের জন্য ব্যবসায়ীদের বিশেষ আয়োজন রয়েছে। যেমন, ওই ব্যবসায়ীর পরামর্শ, ‘‘পারলে নিজের লোক পাঠিয়ে নিয়ে যাবেন। নানা দামের চকলেট বোমা রয়েছে। ১০০ প্যাকেটের ৬০, ৮০ এবং ১২০ টাকা দাম রেখেছি। ফাটলে এলাকা কেঁপে যাবে।’’
এ বার মুদিখানার দোকানের সামনের বেঞ্চে ফিরে এসে বসে সেই ব্যবসায়ী দাবি করলেন, ‘‘পুলিশের বাড়াবাড়ি তো শেষ লগ্নে। তাতে স্থানীয় ব্যবসাটা একটু চটকে গেল বটে। কিন্তু আসল কারবার হয়ে গিয়েছে আগেই। গত এপ্রিল থেকে চকলেট বোমা তৈরি করে রাখা ছিল। অগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন পরিবহণ সংস্থার মাধ্যমে অধিকাংশ চকলেট বোমার বরাত পৌঁছে গিয়েছে। এখানকার সবাই এ ভাবেই ব্যবসা করছেন।’’ চম্পাহাটির বাজি ব্যবসায়ীদের দাবি, দুর্গাপুজোর পরেই পুলিশ তাণ্ডব শুরু করেছে। রাস্তাঘাটে তল্লাশির জন্য গাড়ি আটকাচ্ছে। আতশবাজি চাপা দিয়ে চকলেটের বস্তা পাঠানো হচ্ছিল। তা-ও ধরা পড়েছে পুলিশের জালে।
বারুইপুর পুলিশ জেলা দাবি করছে, এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার নিষিদ্ধ বাজি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নিষিদ্ধ বাজি তৈরির অভিযোগে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই পুলিশ জেলার এক কর্তার কথায়, ‘‘লাগাতার তল্লাশি অভিযান চলছে। চম্পাহাটি এলাকার আশপাশের সব রাস্তায় নজরদারি রয়েছে। সন্দেহজনক গাড়ি দেখলেই, থামিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে।’’
যদিও এত তল্লাশি অভিযান সামলে চম্পাহাটির হারাল, সোলগলিয়া, বেগমপুর-সহ আশপাশের গ্রামগুলিতে আড়ালে-আবডালে গৃহস্থের বাড়িতে বসেই চকলেট বোমা তৈরি করার কাজ চলেছে। শুধু তৈরিই নয়, তা নানা কৌশলে পাচারও হয়ে যাচ্ছে বলে মানছেন এলাকার আতশবাজির ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, পুলিশ যতই তল্লাশি আর বাজেয়াপ্ত করুক, চম্পাহাটিতে চকলেট বোমা তৈরি ও বিক্রি আটকানো অসম্ভব। ফলে কালীপুজোয় ফাটবেই শব্দবাজি।