হাসান আজিজুল হকের হাত থেকে ১৪২২বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার গ্রহণের পরে তাঁকে প্রণাম করছেন সুধীর দত্ত (ডান দিকে)। পাশে আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
কবিতা, কী আছে তোমার পেটিকায়?
যাবতীয় কাঁটাতার ভেঙে শনিবার সন্ধ্যায় গ্র্যান্ড হোটেলে এই প্রশ্নটারই উত্তর খুঁজল দুই বাংলা। বছর কয়েক আগে ‘সংস্কৃতি, কী আছে তোমার পেটিকায়’ বলে প্রশ্ন তুলেছিলেন হাসান আজিজুল হক। এবং উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন, বাঙালি আর বাংলাদেশি সংস্কৃতির কোনও বিভাজনরেখা নেই। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস থেকে আলাওল সবেরই উত্তরাধিকার বহন করে বাংলা ভাষা। এ দিনও তিনি সাফ জানালেন, ‘‘কবিতার কোনও ব্যাখ্যা হয় না। ভাষাই মানুষ। আর সেই ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহার কবিতায়।’’ যে দেশে সাইবারস্পেসে প্রতিবাদের ভাষা লেখার জন্য প্রতিনিয়ত কোনও না কোনও ব্লগার খুন হন, সেই বাংলাদেশ থেকে আসা হাসান এ ভাবেই মানুষের জয়গান গাইলেন, জয়ধ্বনি দিলেন মানুষকে এক সমাজে বেঁধে রাখা ভাষা ও ব্যাকরণের।
মানুষ, ভাষা ও কবিতার এই বিজয়-অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হকই প্রধান অতিথি। ‘তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ’ বইয়ের জন্য এ দিন তিনি ১৪২২ সালের আনন্দ পুরস্কার তুলে দিলেন সুধীর দত্তের হাতে।
সুধীর দত্তের এই রাজ্যে ব্লগাররা খুন হন না ঠিকই, কিন্তু প্রতিনিয়ত হিংসা তাঁকেও যে নাড়ায়! কেন কবিতা লেখেন, বলতে গিয়ে আনন্দ-সম্মানে সম্মানিত কবিও এ দিন বাদ দিতে পারলেন না ‘নখে-দাঁতে হিংস্র লোলুপ’ এই সময়টার কথা। নিজের কবিতা উদ্ধৃত করে জানালেন, ‘লিখি লাভা/ আগ্নেয়গিরির এক একটি বিস্ফোরণ কাদা ধোঁয়া গন্ধক ও আগুনে।’ সল্ট লেকের বাসিন্দা সুধীর জানেন, তাঁর রাজ্যে ভোটের আগে বা পরে কখনওই আগ্নেয়গিরির হিংস্র বিস্ফোরণ থামে না।
এক দিকে যূথচারী হিংস্র সমাজ, অন্য দিকে সেই সমাজে থেকেও ভাষা এবং ছন্দ নিয়ে কবির বিবিক্ত, একক সাধনা। স্বপন চক্রবর্তীর মানপত্র পাঠে রয়ে গেল তারই ইঙ্গিত, ‘কবির নীরবতা দেবতাদেরও আশঙ্কার হেতু। কারণ কবিই ভেদ করতে পারেন
শব্দ আর নৈঃশব্দের মধ্যে সন্ধির রহস্য।’ শুধু বাংলা কেন, পৃথিবীর সব ভাষার কবিই এই রহস্য হাতড়ে বেড়ান! ফরাসি পণ্ডিত রোলাঁ বার্তও তাই পরিষ্কার জানান, ‘আধুনিক কবিরা কবিতাকে স্বপ্নলব্ধ ভাষার ঐশ্বর্য ও নবীনতার আস্বাদনের কারণে ব্যবহার করেন।’
ফেলে আসা ১৪২২ বঙ্গাব্দে বাঙালির কাছে বেশির ভাগ কবিই অবশ্য ছিলেন না স্বপ্নলব্ধ ভাষার প্রতীক। সেটা বোঝা গেল গ্র্যান্ডের বলরুম যখন সবচেয়ে বেশি হাসির ফোয়ারা ছোটাল আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকারের বক্তৃতার একটি লাইনে: ‘‘এক জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াকভস্কির কবিতা অনুবাদ করতেন। জনশ্রুতি, বর্তমান পদাধিকারীও নাকি কবিতা লেখেন, তাঁর অনুগ্রাহকদের মতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চেয়েও ভাল লেখেন।’’ প্রধান অতিথিও মুখ টিপে নিরুচ্চারে হাসতে ছাড়লেন না। তাঁর দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদও যে
কবিকৃতির সাধক ছিলেন! কবিতার রাজনৈতিক প্যাশনে ঢাকা-কলকাতা মাঝে মাঝে একাকার হয়ে যায়।
দুই দেশের বাংলাভাষী রাজনীতিকরা এত কবিতা লিখেও কবি হয়ে উঠতে পারেন না কেন? গ্র্যান্ড হোটেলের বলরুম জানত, এই প্রশ্নের উত্তর আছে এ দিনের পুরস্কারপ্রাপক সুধীরবাবুর একটি পুরনো নিবন্ধে। আশির দশকে সেই নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, যন্ত্রণাসম্ভব আত্মানুসন্ধান থেকেই কবিতার জন্ম। ‘প্রাচীন ঋষিদের বিস্ময় ঋকবেদের স্তোত্রে স্তোত্রে যে ভাবে ঘনিয়ে উঠছে কবিতায়, তা নেই শ্রীমদ্ভাগবতের সংশয়মোচনে।’ রাজনীতির নেতারা হয়তো এই কবিসুলভ সংশয় ও বিপন্ন বিস্ময়ে ভোগেন না। তাই কবিতা শেষ অবধি তাঁদের অধরাই থেকে যায়।
এ দিনের পুরস্কারপ্রাপক অবশ্য কবিতাকে ব্যক্তির প্রেম-প্যাশন-পাপ-পুণ্য-বিস্ময়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তাঁর কাছে কবি এক অক্ষরপুরুষ। ‘‘আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ এই পুরস্কার আমার মতো সাড়ে তিন হাত শীর্ণতনু মানুষকে দেননি, দিয়েছেন অন্তর্গত এক অক্ষরপুরুষকে।’’ তিনি নিজেই একাধারে ব্রহ্ম ও তথাগত। হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি কাব্যগ্রন্থে একদা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘দুঃখ কি আকাশ হয়,
হে আনন্দ? আর্যসত্যের কোথাও কি ভুল ছিল?’
অক্ষরপুরুষ সকলেই হন না, কেউ কেউ হন। দুই বাংলাতেই তাই বহুসংখ্যক, বহুপ্রজ কবিদের নিয়ে হাসির উতরোল। হাসান আজিজুল হক তাঁর বৈঠকী চালে জানালেন, এ কালে এত কবি যে কোনওক্রমে হিসেব রাখা যায় না। বাংলাদেশে বলা হয়, সাধারণ একটা ভিড়েও লাঠি ছুড়লে তা পাঁচ জন কবির গায়ে লাগবে। তার একটু আগে প্রধান সম্পাদক তাঁর ভাষণে সুধীরবাবু কেন বিরল কবি বলতে গিয়ে এই কথাটাই বলেছিলেন— ‘‘সুধীরবাবু ভিড়ের মানুষ নন। তিনি আড়ালে থাকেন। কম লেখেন, কম ছাপেন। ভিড়েও যেমন তিনি নেই, তাঁর কবিতায় শব্দের ভিড়ও তেমন নেই।’’
ভিড়ের বাইরে, নিভৃতচারী সেই কবির হাতেই এ বারের আনন্দ-অর্পণ। সেই কবি যিনি ছুঁয়ে যান শব্দ ও নৈঃশব্দের, অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের বিপ্রতীপতার বর্হিভূত আদিম এক অনুভূতিমালা। ‘শব্দের কাছে ছুটে আসি, আমাদের ক্রোধ বহনের যোগ্য হোক, আগুনেরও পাঠ নিক তারা’— কবিতায় লিখেছিলেন সুধীর। তারও আগে বাংলাদেশে বসে ‘আগুনপাখি’ বা ‘জীবন ঘষে আগুন’-এর কথা লিখেছিলেন যে বর্ষীয়ান লেখক, সেই হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে এ দিনই তাঁর প্রথম পরিচয়। কাঁটাতারের দুই পার, এক জন লেখেন গদ্য, অন্য জন কবিতা। তবু আগুনের বর্ণমালা থিমগত ভাবে দু’জনকেই ছুঁয়ে যায়।
সাহিত্যের ও অনুভূতির সেই স্পর্শলোকে রাজশাহি থেকে আসা আগ্নেয় গদ্যকার কলকাতার অগ্নিময় কবির হাতে তুলে দিলেন আনন্দ-সম্মান। এখানেই শনিবারের সন্ধ্যার সারাৎসার।