ফাইল চিত্র।
একই রাজ্যের দুই প্রান্ত— নন্দীগ্রাম আর রামপুরহাট। ভৌগোলিক দূরত্ব কমবেশি তিনশো-সওয়া তিনশো কিলোমিটার। দুই জায়গায় বুক কাঁপিয়ে দেওয়া দুই ঘটনার সময়গত দূরত্ব দেড় দশক। নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনকারীদের উপরে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় শিউরে উঠেছিল সারা বাংলা। রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে সোমবার রাতে ঘরে আগুন দিয়ে সাত-আট জনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও সুস্থ নাগরিকদের বিচলিত করেছে।
বৃহস্পতিবার কলকাতা হাই কোর্টের মামলায় কার্যত জুড়ে গেল পনেরো বছরের ব্যবধানে ঘটা দু’টি ঘটনা। রামপুরহাটের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে টানা হল নন্দীগ্রামের দৃষ্টান্ত। জনস্বার্থ মামলার আবেদনকারীদের অন্যতম আইনজীবী রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় জানান, ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামের ঘটনায় হাই কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করেছিল এবং নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল সিবিআই-কে। রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে যা হয়েছে, নন্দীগ্রামের থেকে তা কোনও অংশে কম নয়। কোর্টের বাইরে অনেক আইনজীবী মনে করিয়ে দেন, বগটুইয়ের ঘটনার সঙ্গে নেতাইয়ের ঘটনারও তুলনা হতে পারে। সেখানে অভিযোগ ছিল শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধেই।
বগটুইয়ের ঘটনার ‘বীভৎসতা’ ধরা পড়েছে কোর্টের পর্যবেক্ষণেও। তাই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা রুজু করেছে তারা। আইনজীবী প্রীতি কর, অনিন্দ্যসুন্দর দাস-সহ যে-ক’জন এই ঘটনায় জনস্বার্থ মামলা করেছেন, তাঁদের মামলাগুলিও জুড়ে গিয়েছে তার সঙ্গে। স্বতঃপ্রণোদিত মামলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় ও সালোনি ভট্টাচার্য। এ দিন একত্রে সেই সব মামলার শুনানি শেষ হয়। হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, দু’পক্ষের বক্তব্য এবং নথিপত্র খতিয়ে দেখে আদালত তাদের রায় জানাবে।
কোর্ট বুধবারেই রাজ্য পুলিশের ‘সিট’ বা বিশেষ তদন্তকারী দলের কাছে রিপোর্ট এবং কেস ডায়েরি তলব করেছিল। এ দিন তা জমা দেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। অন্যতম মামলাকারী অনিন্দ্যসুন্দর দাসের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি এ দিন পুলিশের এফআইআর, কেস ডায়েরি, ময়না-তদন্তের পদ্ধতি নিয়ে এমন কিছু প্রশ্ন করেছেন, যার সামনে মাঝেমধ্যেই দৃশ্যত বিব্রত দেখিয়েছে রাজ্য সরকারের কৌঁসুলিদের।
এডুলজি কোর্টে জানান, পুলিশের এফআইআরের খুঁটিনাটি দেখা উচিত। পুলিশ কখন, কার কাছ থেকে খবর পেল, থানা থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরত্বের ঘটনাস্থলে তারা পৌঁছলই বা কখন, এফআইআরে অভিযোগকারীর সই আছে কি না— এই সব বিষয় তদন্তের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিতে পারে। ময়না-তদন্তের ভিডিয়োগ্রাফি এবং রিপোর্টে কী আছে, তা দেখলে প্রকৃত ঘটনা বোঝা সম্ভব হবে। একই ঘরে একই সময়ে সাত জন কী ভাবে পুড়ে মারা গেলেন, সেই রহস্য উদ্ঘাটনের প্রয়োজন আছে বলে জানান তিনি। ওই আইনজীবীর মতে, পুলিশের কেস ডায়েরিতে যদি অস্পষ্টতা থাকে, তা হলে এটাই ধরে নিতে হবে যে, তদন্ত ঠিকমতো হচ্ছে না। টাওয়ার ডাম্পিং প্রযুক্তি ব্যবহার করলে মোবাইল ফোনের নম্বরের মাধ্যমে ঘটনার সময় বগটুইয়ে কারা ছিলেন, তা চিহ্নিত করা সম্ভব। রাজ্য সরকার সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত।
অনেক আইনজীবীর বক্তব্য, এই ঘটনা আর-পাঁচটা খুনের মতো নয়। এই নৃশংসতা কার্যত সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সেটাই ধরা পড়েছে প্রীতি করের আইনজীবী কৌস্তুভ বাগচীর গলায়। তিনি এ দিন কোর্টে বলেন, ‘‘এই ঘটনা যদি বিচার ব্যবস্থাকে বিচলিত না-করে, তা হলে আর কোন ঘটনা বিচলিত করতে পারে?’’ ওই কৌঁসুলির আর্জি, পুলিশ দায়িত্ব পালন করেনি। তাই নিরপেক্ষ সংস্থাকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিক আদালত।
অন্য কৌঁসুলি সব্যসাচীবাবু এ দিন অভিযোগ করেন, কোর্টের নির্দেশের পরেও বগটুইয়ে বুধবার রাত পর্যন্ত কোনও সিসি ক্যামেরা বসানো হয়নি। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই ধরনের কাজ নিরপেক্ষ তদন্তে প্রভাব ফেলতে পারে। নিরপেক্ষ তদন্ত শুধু সত্য উদ্ঘাটনের জন্যই প্রয়োজন নয়, আতঙ্কিত মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্যও দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি। অন্য এক জনস্বার্থ মামলাকারীর আইনজীবী প্রিয়ঙ্কা টিবরেওয়াল কোর্টে বলেছেন, কী ভাবে তদন্ত করতে হবে, মুখ্যমন্ত্রী সেই ব্যাপারে প্রকাশ্যে রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে নির্দেশ দিচ্ছেন! এ ভাবে কোনও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে না।
সালোনির আইনজীবী শামিম আহমেদ সরাসরি পুলিশকেই নিশানা করেছেন। তাঁর অভিযোগ, একদা রিজওয়ানুর রহমানের অপমৃত্যুর মামলায় অভিযুক্ত জ্ঞানবন্ত সিংহকে এই সিটের প্রধান করা হয়েছে। কয়লা পাচারের মামলায় ওই অফিসারকে সমন পাঠিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বগটুইয়ে এ-হেন অফিসারকে দায়িত্ব দিয়ে তদন্তকেই বিপথে চালিত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, এই ঘটনার সঙ্গে বালি খাদান এবং অবৈধ বালি ব্যবসা জড়িত। তাই বৃহত্তর অপরাধের তদন্তও প্রয়োজন। অন্য একটি মামলায় রাজ্যে অবৈধ বালি খাদান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। সেই নির্দেশ কতটা পালন করা হয়েছে, বগটুই কাণ্ড তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
রাজ্য সরকারের এজি দাবি করেন, তাঁরা কোর্টের সব নির্দেশ পালন করেছেন। সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিয়েছে পুলিশ। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, সারবত্তাহীন অভিযোগ তুলছেন জনস্বার্থ মামলার আবেদনকারীরা। এই পর্বে বেশ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতেই ছিলেন তিনি। এজি আরও দাবি করেন, জ্ঞানবন্ত রাজ্যের ‘সেরা পুলিশ অফিসারদের’ এক জন। তাই তাঁকে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। তবে বগটুইয়ে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক দল যায়নি বলে জানান তিনি। এজি-র বক্তব্য, সিআরপি-র নিরাপত্তা ছাড়া কেন্দ্রীয় দল যেতে রাজি হয়নি। পরে কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ওয়াই জে দস্তুর অবশ্য জানান, একসঙ্গে বিমানের টিকিট মেলেনি। আলাদা আলাদা বিমানে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিকের বিজ্ঞানীরা বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যেই কলকাতায় পৌঁছচ্ছেন। সিআরপি-র বন্দোবস্তও করা হয়েছে।