থানায় গেলে কী হয় জানা আছে, ক্ষিপ্ত চেল্লুর

সারা রাজ্যে সিন্ডিকেট-রাজের দাপট নিয়ে দিন পাঁচেক আগেই মুখর হয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সিন্ডিকেট-দৌরাত্ম্যের প্রতিকারে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে বুধবার তোপ দাগলেন তিনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৬ ০৪:৩৮
Share:

মঞ্জুলা চেল্লুর

সারা রাজ্যে সিন্ডিকেট-রাজের দাপট নিয়ে দিন পাঁচেক আগেই মুখর হয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সিন্ডিকেট-দৌরাত্ম্যের প্রতিকারে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে বুধবার তোপ দাগলেন তিনি।

Advertisement

রাজ্যের সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী পর্যন্ত সকলেই সিন্ডিকেটের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তাদের হাত এতটা লম্বা আর পেশিশক্তি এতই বেশি যে, ভিন্‌ রাজ্য এবং পড়শি রাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরাও রেহাই পাচ্ছেন না।

নেপালের এমনই দুই ব্যবসায়ীর মামলায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও জুলুমবাজির বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা না-নেওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। বলেন, ‘‘ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আদালত পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল। তবু কাজ হয়নি। কেন? থানায় গেলে কী হয়, তা আমাদের জানা আছে!’’ কেন আদালতের নির্দেশ মানা হয়নি, আজ, বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির হয়ে তা জানাতে বলা হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারকে।

Advertisement

দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই সিন্ডিকেটের মোকাবিলায় তৎপর হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবাসন থেকে শুরু করে ছোট-বড় সমস্ত শিল্পই যে সিন্ডিকেটের জুলুমবাজির শিকার, সেই ব্যাপারে হাজারো অভিযোগ উঠছে রোজই। এই দাদাগিরি যে রাজ্যে লগ্নির বড় বাধা, সেটা উপলব্ধি করেই মুখ্যমন্ত্রী কড়া হাতে রাশ ধরতে চাইছেন বলে রাজনৈতিক শিবিরের পর্যবেক্ষণ। তারা মনে করছে, নিজের দলের কাউন্সিলরকে (অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়) শ্রীঘরে পাঠানোটা মুখ্যমন্ত্রীর সেই কঠোর পদক্ষেপেরই প্রমাণ। উচ্চ আদালত যে এই ধরনের ব্যবস্থায় কিছুটা সন্তুষ্ট, প্রধান বিচারপতি চেল্লুরের আগেকার মন্তব্যে সেটা প্রকাশ পেয়েছিল।

‘‘সিন্ডিকেটের জুলুম বন্ধ করতে কয়েকটি ক্ষেত্রে সরকার যে-ব্যবস্থা নিয়েছে, তা ভাল। কিন্তু এ-পর্যন্ত যা প্রকাশ্যে এসেছে, তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র,’’ গত ১৫ জুলাই বলেছিলেন প্রধান বিচারপতি। সিন্ডিকেটের জুলুম সংক্রান্ত একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে সিন্ডিকেট-রাজের বিরুদ্ধে সে-দিনই প্রথম সরব হন তিনি।

সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা যে প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য, সেই মন্তব্যেই তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি। সরকার উদ্যোগী হলেও পুলিশ যে সিন্ডিকেটবাজি রুখতে সক্রিয় নয়, চেল্লুরের এ দিনের পর্যবেক্ষণে সেটা স্পষ্ট। নেপালের দু’টি বাণিজ্যিক সংস্থা বজবজে
সিন্ডিকেটের জুলুমের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ পেয়েই পুলিশকে দুরমুশ করেন তিনি। জানিয়ে দেন, পুলিশ কার্যক্ষেত্রে কতটা কী করে, সেটা আদালতের জানা আছে! আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও বজবজ পুলিশ কেন সক্রিয় হয়নি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারকে হাইকোর্টে হাজির হয়ে তা জানাতে হবে।

আবেদনকারী ব্যবসায়ীদের আইনজীবী সুবীর সান্যাল ও রাতুল বিশ্বাস আদালতে বলেন, তাঁদের মক্কেলরা নেপালে ভোজ্য তেলের কারবার করেন। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ভোজ্য তেল এনে প্রথমে বজবজের মাদার ডেয়ারির একটি গুদামে রাখা হয়। আগে বিশেষ ধরনের ট্যাঙ্কারে সড়কপথে বিহারের রক্সৌল হয়ে সেই তেল নেপালে নিয়ে যাওয়া হতো। এখন খরচ কমানোর জন্য রেল মারফত তা নেপালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই কাজের জন্য নেপালের ওই দু’টি সংস্থা ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চুক্তিও করেছে। ওই দুই সংস্থার নিজস্ব এজেন্ট আছেন।

কিন্তু গত বছর থেকে ‘বজবজ এডিবল ওয়েল ট্যাঙ্কার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’ রেলে তেল পাঠানোর কাজে বাধা দিচ্ছে বলে নেপালের সংস্থা দু’টির অভিযোগ। কৌঁসুলিরা জানান, সংগঠনের ট্যাঙ্কারে সড়কপথে তেল পাঠানোর জন্য চাপ দিচ্ছে ওই অ্যাসোসিয়েশন। সড়কপথে তেল সরবরাহ করতে রাজি না-হওয়ায় তাঁদের মক্কেলদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এর প্রতিকার চেয়ে ওই ব্যবসায়ীরা কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।

মামলাটি প্রথমে ওঠে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে। ১৬ জুন বিচারপতি দত্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশকে নির্দেশ দেন, ওই দুই সংস্থার এজেন্টরা যাতে রেলপথে তেল পাঠাতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। উল্টে এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে আবেদনকারীদের দুই কৌঁসুলির অভিযোগ। তাঁরা জানান, এই বিষয়ে জেলাশাসক, পুলিশ সুপার এবং বজবজ থানার ওসি-র কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

বিচারপতি দত্তের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে মামলা করেন বজবজ পুরসভার তিন কাউন্সিলর এবং কয়েক জন ট্যাঙ্কার-মালিক। এ দিন সেই মামলার শুনানিতে ব্যবসায়ীদের কৌঁসুলি সুবীরবাবু আদালতে অভিযোগ করেন, বজবজের ট্যাঙ্কার অ্যাসোসিয়েশন যা চাইছে, তা কার্যত সিন্ডিকেটের জুলুমবাজি।

ট্যাঙ্কার সংগঠনের আইনজীবী কিশোর দত্ত অবশ্য আদালতে জানান, এটা স্থানীয় ব্যবসায়ী, ট্যাঙ্কার-চালক, খালাসিদের জীবিকার প্রশ্ন। জুলুমের অভিযোগ ঠিক নয়। প্রধান বিচারপতি কিন্তু ট্যাঙ্কার সংগঠনের এই বক্তব্য মানতে চাননি। কিশোরবাবুর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘এতে যে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে, সেটা জানেন কি?’’ তার পরেই ডিভিশন বেঞ্চ দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারকে আদালতে হাজির হয়ে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়।

বজবজ ট্যাঙ্কার অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তার দাবি, রেলে তেল সরবরাহের কাজে বাধা বা হুমকি দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আসলে চালক-খালাসিরাই নেপালের ওই ব্যবসায়ীদের মালপত্র তুলতে চাইছেন না। তাঁরা পুলিশকে সেটা লিখিত ভাবে জানিয়েও দিয়েছেন। এলাকার লোকজনের জীবিকার প্রশ্ন জড়িত বলেই নেপালের ব্যবসায়ীদের সড়কপথে তেল সরবরাহ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement