শুনশান: ভোটের ফলাফলের পরেও নিস্তরঙ্গ দেগঙ্গার গাঙাটি গ্রাম। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
গোটা গ্রাম কার্যত শুনশান। রাস্তাও কার্যত জনমানবহীন। গোটা এলাকায় লোক বলতে দু’-একটি শিশু, যারা বাড়ির উঠোনে খেলছে। জায়গায় জায়গায় দলীয় পতাকা ঝুললেও উৎসবের কোনও বালাই নেই। একটু দূরে গেলে দু’-একটি রাস্তার মোড়ে কয়েক জনের জটলা থাকলেও আর কিছুই চোখে পড়ল না। ভোটে জেতার আনন্দে আশপাশে বিজয়োৎসব শুরু হলেও তার রেশ এসে পৌঁছয়নি সোহাই শেবপুরের গাঙাটি গ্রামে। ভোট-সন্ত্রাসে এলাকার বছর সতেরোর কিশোরের মৃত্যুর পরে আপাতত গ্রামে কোনও বিজয় মিছিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাসিন্দারা।
ইমরান হোসেন নামে ওই কিশোরের মৃত্যুর প্রতিবাদে ভোটকেই বেছে নিয়েছিল তার পরিবার। শনিবার সকালে ভোট দিয়েছিলেন বাবা এমদাদুল হক। সকালে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বিকেলে মত বদলান ইমরানের মা মমতাজ বেগম। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার মাধ্যমেই তিনি ছেলের মৃত্যুর প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন। দাবি করেছিলেন, দোষীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
তবে মঙ্গলবার সেখানেই থেমে থাকলেন না ইমরানের বাবা। দলীয় প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে গণনা এজেন্ট হিসেবে এ দিন দেগঙ্গায় পৌঁছে গেলেন তিনি। গণনা কেন্দ্রে দাঁড়িয়েই এমদাদুল বললেন, ‘‘সন্ত্রাসের জবাব তো ভোট দিয়েই শেষ হয় না। ভয় পেলে চলবে না। জয়ী হতে ভোটেও জিততে হয়। তাই বাড়িতে বসে থাকতে পারিনি।’’
সোহাই শেবপুর পঞ্চায়েতের গাঙাটি গ্রামে গত ৪ জুলাই বোমার আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল বছর সতেরোর কিশোর ইমরানের। প্রচারে বেরোনো বাবাকে ডাকতে গিয়ে রাতে ফেরার পথে তাকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। তৃণমূলকর্মী বাবার সামনেই মৃত্যু হয় তার। ওই ঘটনার পরে ভয়ে কার্যত গ্রামছাড়া বিরোধীরা। ভোটে বুথে এজেন্ট পাঠানো তো দূর, অধিকাংশ সমর্থক ভোটও দিতে যাননি। সোয়াই শেবপুর পঞ্চায়েতের ৮৫ নম্বর ওই বুথে ১২০০-র কাছাকাছি ভোটার থাকলেও ভোট পড়েছিল ৭০০-র কাছাকাছি। ফল বেরোনোর পরে দেখা যায়, বিরোধীরা গুটিকয়েক ভোট পেলেও বাকি ভোট পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী।
তবে বড় ব্যবধানে জয়ের উচ্ছ্বাস এ দিন দেখা যায়নি গ্রামে। দুপুরে ইমরানের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, কয়েক জন প্রতিবেশী ভিড় করে রয়েছেন। ঘরে হাঁটু মুড়ে বড় ছেলেকে ধরে বসে থাকা ইমরানের মা কেঁদে চলেছেন। শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘‘দু’বছর আগেও এমন জেতার দিনে ছেলেটা কত আনন্দ করেছিল। কিন্তু আজ দেখো, সেই ছেলেটাই আর নেই। এই ভোটই ওকে শেষ করে দিল।’’
তবে গাঙাটি গ্রাম বাদ দিলে দেগঙ্গা ব্লকের ছবিটা ছিল ভিন্ন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েতে কার্যত বিরোধী শূন্য ওই ব্লকের ১৩টি পঞ্চায়েতে তৃণমূলকে জোর টক্কর দিয়েছে বাম-আইএসএফ জোট। একাধিক পঞ্চায়েতে জয়ীও হয়েছেন জোট প্রার্থীরা। তার জেরেই এলাকায় রয়েছে চাপা উত্তেজনা। বিশেষত, দেগঙ্গা, বারাসত-১ নম্বর ব্লকের যে এলাকাগুলি গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে উত্তপ্ত হয়েছিল, রক্ত ঝরেছিল ভোটের দিন, সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে চাপা আতঙ্ক। কদম্বগাছি, পীরগাছা, চাকলা, বেলপুর-বেলডাঙা— সর্বত্র এই ছবি দেখা গিয়েছে। প্রতিরোধের ‘মাসুল’ গণনার পরে চোকাতে হবে না তো? কান পাতলেই যেন শোনা যাচ্ছে এই প্রশ্ন।