এখনও মাস্কহীন অবস্থায় ঘুরতে দেখা যাচ্ছে অনেককে। ফাইল চিত্র।
মকর সংক্রান্তিতে সব ধর্মীয় জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে পড়শি রাজ্য ওড়িশা। পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গাসাগর মেলা বা উত্তরপ্রদেশে ভোটের ঢক্কা নিনাদ চলছে। রাজ্যে পুরভোটেরও দামামা বাজছে। কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কাতেও দেশের যা ভাবগতি, তাতে ওড়িশার ভূমিকা খানিক ব্যতিক্রম।
ওরা পারে, আমরা পারি না! এই বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন চোখ রাঙাচ্ছে কোভিড সংক্রমণের পরিসংখ্যান। পশ্চিমবঙ্গে তিন জনের মধ্যে একজন কোভিড পজিটিভ! তবু পুজো থেকে বড়দিন বা ইংরেজি বর্ষবরণ, নৈশ বিধি শিথিল করা, বা মেলা-ভোটের দায় আদালতের উপর ছেড়ে চুপ করে থাকার প্রশাসনিক রেওয়াজ চলছেই। সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক মইদুল ইসলাম বলছেন, “আমাদের দেশের মানুষের পক্ষে নানা কারণে কোভিড-বিধি পুরোটা মেনে চলাটা মুশকিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংক্রমণ বাড়লেও সব কিছু ছেড়ে ধর্মীয় মেলা এবং ভোট হচ্ছে, এটা পরিষ্কার রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাধ্যবাধকতা। সব দলের কাছেই মানুষের জীবনের থেকে ভোট রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ।”
আপাত ভাবে জনজীবনেও ভয়ের ছিটেফোঁটা নেই। অম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক রুক্মিনী সেনের কথায়, “প্রশাসনের নানা ভূমিকায় দেশে কোভিড পরিস্থিতি যে ঘোরালো হয়েছে, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সঙ্গে জনতার হাবভাবও তাৎপর্যপূর্ণ। সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা ব্যাপারটাই আমাদের ধাতে নেই। কোভিড-বিধি মানার ক্ষেত্রেও তার ছাপ পড়ছে।” কলকাতা থেকে জেলা শহর, রাজপথের ছবিটা দেখলে কে বলবে, ভাইরাসের আদৌ অস্তিত্ব আছে। বাজারে থিকথিকে ভিড়। প্রাতর্ভ্রমণ শেষে চায়ের আড্ডা। ভয়ের কিছু আছে বললেই অনেকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন। ‘প্যারাসিটামলে প্যানডেমিক বিজয়’ নিয়ে লঘু আড্ডা সমাজমাধ্যমে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং অন্যত্র বিভিন্ন শ্রেণির কোভিড রোগীদের টানা দু’বছর দেখছেন চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার। তিনি কিন্তু বলছেন, “ওমিক্রনের প্রভাব মৃদু মনে হলেও ডেল্টার সংক্রমণ এখনও মুছে যায়নি। এখনও মেডিক্যালে দৈনিক ২৫-৩০ জন ভর্তি হচ্ছেন। অনেকেই দ্রুত সেরে উঠছেন। কিন্তু রোগটাকেই উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা মারাত্মক।”
দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী শপিংমল তথা মাল্টিপ্লেক্সের আধিকারিকের কথায়, “ডিসেম্বরের শেষ দিনগুলোর থিকথিকে ভিড়ের তুলনায় ৩০-৩৫ শতাংশ এখন মলে আসছেন। তবে রেস্তরাঁ বা সালোঁ বিলাসের প্রবণতাও বাড়ছে।” এমন বেপরোয়া জীবনচর্যা ছাড়াও মাস্ক পরার ত্রুটি বা যত্রতত্র থুতু ফেলার বদঅভ্যেসও সমান তালে বহাল। রুটিরুজির জন্য যাঁদের না-বেরোলে চলে না তাঁরা, না যাঁরা শখ করে বাইরে বেরোচ্ছেন, কারা সুপারস্প্রেডারের ভূমিকায়, প্রশ্নটা কিন্তু ভাবাচ্ছে অনেককেই।
প্রশাসন ও সাধারণ নাগরিকের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং দুঃসাহসে বিচলিত জনস্বাস্থ্য বিশারদেরাও। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথের ডিরেক্টর-অধ্যাপক মধুমিতা দোবের কথায়, “লোকে কোভিডে সহজে মারা যাচ্ছে না, এটা আত্মসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে না। ইবোলার মতো রোগের ভাইরাসগুলো মানুষকে প্রাণে মারে, নিজেও মরে যায়। কোভিডের ভাইরাস আলাদা। তার সংক্রমণ ছড়ানো রুখে দেওয়াটাই সামাজিক দায়িত্ব।”
কোভিড-বিভীষিকা হাড়ে হাড়ে চেনেন অপরাজিতা মুখোপাধ্যায়। স্বামী নিতাইদাস প্রায় মাসখানেক ধরে কোমায়, বাড়িতে দুই বয়স্কা আত্মীয়া—ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখেছেন তিনি। অপরাজিতা বলছিলেন, “জীবন বিপন্ন করে ভোট হচ্ছে আর লোকে জমিয়ে বাজার বা নৈশ পার্টি করছে, কোনওটাই দায়িত্ববোধের পরিচয় নয়। কোভিডের ভয়ানক চেহারাটা কী করে সরকার থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই এত দ্রুত ভুলে গেল, সেটাই আশ্চর্যের।”