বেহালার তারাতলার ফ্ল্যাটে পুরনো দিনের স্মৃতিচিহ্ন ফিরে দেখছেন অপরেশ রায়। পাশে স্ত্রী। শুক্রবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
বেহালার এক চিলতে ফ্ল্যাটে একবুক মেঘভারাতুর অভিমান নিয়ে সোফায় এলিয়ে বসলেন ৮৫ বছরের যুবক অপরেশ রায় ওরফে অপু।
১৫ বছর আগেকার আচমকা স্ট্রোক ডান দিকে সামান্য অসাড়তা দিয়েছে, কেড়ে নিতে পারেনি কিছুই। ৪৫ বছরের আগের স্মৃতি তাই শীতের রডোডেনড্রনের মতোই টাটকা। গ্র্যান্ড হোটেলের ৩১৮ নম্বর ঘরে টোকা মারা থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টার সেই স্বপ্ন-সঙ্গ, সেলুলয়েডের পর্দার মতো চোখের সামনে ফুটে উঠছিল। কথা একটু জড়িয়ে গিয়েছে অপুর। তবে সচেতন উচ্চারণ বেশ স্পষ্ট।
১৯৭৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। স্পোর্টস মেডিসিন নিয়ে মাত্র এক বছর আগেই কোর্স করেছেন। ফার্স্ট ডিভিশনের গোলকিপার অপু তখন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। ফুটবল-সম্রাট পেলে আসছেন শুনেই কি সটান হাজির গ্র্যান্ডে? হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। টকটকে লাল রঙের ফুলহাতা জাম্পার গায়ে দীপ্ত প্রতিবাদ, ‘‘দশ বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ১৯৬৬ সালে ডেভিস কাপে খেলতে এসেছিল ব্রাজিল। আলাপ হয়েছিল টমাস কুকের সঙ্গে। ব্রাজিলের টেনিস প্লেয়ার। আমি তখন ভারতের ডেভিস কাপ দলের ফিজ়িক্যাল ইনস্ট্রাক্টর। টমাসকে বলেছিলাম, পেলের সঙ্গে কাজ করতে চাই। পেলে তখনও বিশ্বকাপ খেলছে। টমাস বলল, ‘বেশ তো! চলে আসুন না ব্রাজিলে।’ যাওয়া হয়নি। আমাকে দশ বছর অপেক্ষায় রেখে পেলে-ই এল কলকাতায়।’’
গ্র্যান্ড হোটেলের ঘরে দরজা খুলেছিলেন অন্য এক জন। সম্ভবত ঢুকতে দিতেন না। তবে টমাসের নাম করায় ভিতর থেকে উঁকি মেরে ডেকে নিয়েছিলেন পেলে। অপুর স্ত্রী, ৭৮ বছরের ছিপছিপে শিখার কথায়, ‘‘আর তার পরের আড়াই ঘণ্টা, সম্ভবত ওর (অপুর) জীবনের সব চেয়ে সুখকর স্মৃতি।’’ এখনও চোখ চকচক করে ওঠে অপুর। বাধ্য ছেলের মতো কী ভাবে তাঁর একটার পর একটা নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছিলেন ফুটবল-সম্রাট, তা-ই বলে যাচ্ছিলেন অনর্গল। কিন্তু তাঁর কথা পেলে মেনে নিলেন কেন? তাল কেটে যাওয়ায় গলা তুলে অপু বললেন, ‘‘শুনবে না? বললাম, যে-জেট ল্যাগ ছড়িয়ে আছে তোমার শরীরে, তা নিয়ে খেলবে কী করে? বিশ্রাম তো পাওনি। পাবেও না। আগে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে এসো। শুধু দেহ নয়, মনও সতেজ করা দরকার। নইলে যোগাসন কোনও কাজে আসবে না। স্নান সেরে অন্তর্বাস পরা পেলে যখন মেঝেতে গদির উপরে শুয়ে, তখন আমার ক’টি আঙুল নেচে বেড়াচ্ছিল সম্রাটের শরীরে। আমেজে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল ও।’’
তার পরে দু’জনে একসঙ্গে বেশ কিছু শারীরিক কসরত, যোগাসন করার পরে জড়িয়ে ধরেন পেলে। ছাড়তে চাননি। পরের দিন, শনিবার খেলার আগে পেলের অনুরোধে সকালে হোটেলে যেতে হয়েছিল অপুকে। কসমস টিম-বাসের সঙ্গে যেতে হয়েছিল মাঠে। খেলা শেষে মাঠ ছেড়েছিলেন অপু। সেই শেষ দেখা। ধরে আসে গলা, ‘‘ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলত পেলে। একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে কাগজে খবরটা দেখলাম। আমার থেকেও তো বয়সে ছোট। জয়দীপ (টেনিস তারকা জয়দীপ মুখোপাধ্যায়) ফোন করে বলল, কী, বন্ধু তো চলে গেল?’’
২০১৫ সালে তো আবার এক বার কলকাতায় এসেছিলেন পেলে? দেখা করতে যাননি?
প্রায় অবশ হয়ে আসা ডান হাতটা অভিমানে খানিক কেঁপে উঠল কি, ‘‘কই, আমাকে তো ও ডাকেনি!’’