পলাশির যুদ্ধ, সিপাহি বিদ্রোহের বৃত্তান্ত ঐতিহাসিক কারণেই ছাত্রপাঠ্য হয়ে উঠেছে। তেভাগার কৃষক আন্দোলনও ঠাঁই করে নিয়েছে পাঠ্যক্রমে। এ বার পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-পাঠ্যক্রম পেতে চলেছে এক নতুন আন্দোলনের গল্প। সিঙ্গুরের কৃষক আন্দোলন।
সিঙ্গুরে কৃষকদের জমি ফেরতের জয়গাথা স্কুলপাঠ্যের অন্তর্গত করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। শুক্রবার নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি জানান, সিঙ্গুরের আন্দোলন যুগান্তকারী। আদালতের রায়ে তা ইতিহাসের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণিজন শিক্ষা দফতরকে প্রস্তাব দিয়েছেন, এমন এক ঐতিহাসিক ঘটনাকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যাতে পড়ুয়ারা কৃষকদের জমি আন্দোলনের এই লড়াইয়ের কথা জানতে পারে। ‘‘শিক্ষা দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিষয়টি যাতে স্কুলের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়, সেই জন্য ওই প্রস্তাব সিলেবাস কমিটির কাছে পাঠানো হবে,’’ বলেন পার্থবাবু।
শাসকের এই ইচ্ছে নিয়ে বিতর্ক শুরু হতে দেরি হয়নি। শিক্ষাবিদদের একাংশের বক্তব্য, সিঙ্গুরের ওই আন্দোলনকে পাঠ্যক্রমে আনলে অন্য অনেক আন্দোলনের প্রতি অবিচার করা হবে। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রতিটি রাজ্যই আঞ্চলিক লড়াই, জীবনযাপন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কথা মাথায় রেখে পাঠ্যক্রম তৈরি করে। শিবাজির কথা মহারাষ্ট্রের স্কুলে স্কুলে যতখানি পড়ানো হয়, এই রাজ্যে প্রায় ততটাই পড়ানো হয় কার্ল মার্ক্সের কাহিনি। কিন্তু সিঙ্গুর আন্দোলন সেই পর্যায়ের গুরুত্ব লাভ করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
শিক্ষা শিবিরের একটি অংশের বক্তব্য, সরকার আসলে নিজেদের প্রচারের জন্য পাঠ্যক্রমকে হাতিয়ার করতে চাইছে। সিঙ্গুর আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে দলীয় রাজনীতি। যা পাঠ্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে বলে ওই সব শিক্ষাবিদের আশঙ্কা। তাঁদের প্রশ্ন, সিঙ্গুর আন্দোলন কি এখনই সত্যি সত্যি ইতিহাস হয়ে গিয়েছে?
সিঙ্গুর আন্দোলন যে সাম্প্রতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ, সেই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্রের। তাঁর বক্তব্য, ডিভিসি তৈরির সময়কার কৃষি আন্দোলনে গুলি, তেভাগা, নকশালবাড়ি-সহ রাজ্যে কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিক পরিপ্রেক্ষিতে সিঙ্গুর-কাণ্ডের বৈশিষ্ট্য পাঠ্যক্রমে রাখলে তবেই তার সার্থকতা আছে। ‘‘তা না-হলে ঘটনার বিবৃতি কোনও একটি বিশেষ দল বা দলনেত্রীর মাহাত্ম্যগাথায় পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকেই যায়,’’ বলছেন গৌতমবাবু।
একই রকম আশঙ্কা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সিঙ্গুর আন্দোলনকে সিলেবাসে রাখা মানে রাজ্যের অন্যান্য আন্দোলনকে ছোটো করা। কারণ, এটা সার্বিক কৃষক আন্দোলন নয়। ‘‘এটা আসলে রাজনৈতিক আন্দোলন,’’ মূল্যায়ন অমলবাবুর। সিঙ্গুরকে পাঠ্য করার উদ্যোগের মধ্যে সরকারের গায়ের জোরের যুক্তি দেখছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলছেন, ‘‘চিরকালই রাষ্ট্র তার নিজের মতো করে ইতিহাস তৈরি করে।’’ আর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, স্কুল-কলেজের সিলেবাস কী হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে কোনও ধারণাই নেই এই সরকারের।
শিক্ষক সংগঠন নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি মনে করে, সিঙ্গুরকে পাঠ্যক্রমে ঢোকানোর সিদ্ধান্ত ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। সিপিআই-সমর্থক বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সংগঠনের রাজ্য সহ-সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘‘এই আন্দোলনও পড়ুয়াদের পড়াতে হবে! এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষায় কী দৈন্য চলছে।’’ তোপ দাগায় পিছিয়ে নেই কংগ্রেসও। প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘পার্থবাবু শুধু সিঙ্গুরের সাফল্যকে সিলেবাসে যোগ করবেন কেন? সারদা-নারদে তাঁদের সাফল্যকেও যোগ করুন! তাতে আরও ভাল হবে।’’
তবে শাসকের ইচ্ছের মধ্যে যুক্তির অভাব দেখছেন না শিক্ষা শিবিরেরই একটি অংশ। তাঁদের বক্তব্য, সিঙ্গুর আন্দোলন এই রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের এক মাইলফলক। সিঙ্গুরের কৃষক আন্দোলন না-জানলে রাজ্য-রাজনীতির খণ্ড সত্য জানা যাবে, পূর্ণ সত্য নয়। স্বাভাবিক কারণেই সরকারের সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি। ওই সংগঠনের সভাপতি দিব্যেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। অবশ্যই পাঠ্যক্রমে থাকা উচিত। শিক্ষামন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তে আমরা খুশি।’’
এই চাপান-উতোরের মধ্যে সিলেবাস কমিটির এক সদস্য জানান, শিক্ষামন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী সিঙ্গুরের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হলে পুরনো নিয়ম পরিমার্জন করতে হবে। ফলে শুধু সিঙ্গুর আন্দোলন, নাকি আরও কিছু যুক্ত করতে হবে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা প্রয়োজন। সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার বলেন, ‘‘প্রস্তাবটি এখনও দেখিনি। আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রস্তাব পাওয়ার পরে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী রূপরেখা তৈরি করব। তবে এটুকু বলাই যায়, সিঙ্গুর আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামেরই সম্প্রসারণ।’’