পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
গাদাগাদি দশা দেশের জেলগুলিতে। ঠাসাঠাসি করে কার্যত দমবন্ধ অবস্থায় বেঁচে রয়েছেন জেলবন্দিরা। যাঁদের অধিকাংশই বিচারাধীন। তাঁদের মুক্তির ব্যবস্থা করে জেল খালি করা যায় কি না, সম্প্রতি কেন্দ্রকে তা দেখতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের সেই নির্দেশ মেনে ইতিমধ্যে সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্র। বিচারাধীন বন্দিদের জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা কী ভাবে করা যেতে পারে, কেন্দ্রের চিঠিতে সেই সংক্রান্তই নির্দেশিকা রয়েছে। সেই নিয়মকানুন মেনে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায় কি জামিনে মুক্তি পেতে পারেন? এই প্রশ্ন ঘিরে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মুখ্যসচিব এবং জেল সুপারদের যে চিঠি দিয়েছে, তাতে চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিএনএসএস)-র ৪৭৯ (১) ধারার উল্লেখ করা হয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশ, ওই ধারার নিয়মকানুন মেনে বন্দিদের জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্র জানিয়েছে, বিএনএসএস-র ৪৭৯ (১) ধারায় একটি নতুন নিয়ম যোগ করা হয়েছে। সেখানেই প্রথম বার কোনও অপরাধে অভিযুক্ত বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে নিয়মকানুন রয়েছে। প্রথম বার অভিযুক্ত কোনও বিচারাধীন বন্দি যদি সর্বোচ্চ কারাবাসের সাজার এক তৃতীয়াংশ সময় জেলে থাকেন, তা হলে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারেন জেল সুপার। তিনিই সংশ্লিষ্ট আদালতে গিয়ে ওই বন্দির জামিনের আবেদন করতে পারেন।
আইনজীবীদের একাংশের মত, এই নিয়মকে হাতিয়ার করেই পার্থ এবং অর্পিতার জামিনের আবেদন করা যেতে পারে আদালতে। তবে তাঁরা জামিন পাবেন কি না, তা স্বাভাবিক ভাবেই আদালত বিচার করবে। আইনজীবীদের ওই অংশ সুপ্রিম কোর্টের আরও একটি পর্যবেক্ষণ মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সম্প্রতি আর্থিক অপরাধ দমন আইনের মামলায় ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের সহকারী হিসাবে অভিযুক্ত প্রেম প্রকাশের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল— ‘‘জামিনই নিয়ম। জেল ব্যতিক্রম, এমনকি আর্থিক দুর্নীতির মামলাতেও।’’ বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের ধারায় অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও তা কার্যকর হতে পারে বলেও জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এ বার শীর্ষ আদালতের বিচারপতি হৃষীকেশ রায় এবং এসভিএন ভাট্টির বেঞ্চও বিচারাধীন বন্দিদের মুক্তির বিষয় পদক্ষেপ করারও নির্দেশ দিয়েছে। শীর্ষ আদালতের ওই পর্যবেক্ষণ এবং নির্দেশ নজর রেখেই আইনজীবীদের কেউ কেউ মনে করছেন, পার্থ-অর্পিতাও জামিন পেতে পারেন বিএনএসএস)-র ৪৭৯ (১) ধারার বিধি মেনে।
২০২২ সালের ২৩ জুলাই গ্রেফতার হয়েছিলেন পার্থ-অর্পিতা। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি তাঁদের গ্রেফতার করেছিল। তার পর প্রায় দু’বছর তিন মাস কেটে গিয়েছে, দু’জনেই জেলে বন্দি এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা এখনও আদালতে বিচারাধীন। তাঁরাও সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশের সুবিধা পেতে পারেন বলে জানাচ্ছেন কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী তাপস ভঞ্জ। তিনি বলেন, ‘‘জেলে উপচে পড়া ভিড় কমাতে সুপ্রিম কোর্ট এই নির্দেশ দিয়েছে। সব রাজ্যের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। আদালতের উদ্দেশ্য, বিচারাধীন বন্দিদের এক তৃতীয়াংশ কারাবাস সম্পূর্ণ হলে তাঁদের জামিনে মুক্ত করা। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা অর্পিতা মুখোপাধ্যায়রাও নির্দেশের ওই সুবিধা পেতে পারেন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে ক’টি মামলা রয়েছে। ওই মামলাগুলিতে সর্বোচ্চ কত বছর সাজা হতে পারে, তা বিবেচনা করে তাঁরা জামিন পেতে পারেন।’’ উচ্চ আদালতের আর এক আইনজীবী সঞ্জয় বর্ধনও বলছেন, ‘‘বিনা বিচারে কাউকে দীর্ঘ দিন আটকে রাখা যায় না। দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দোষী বলা যায় না। খুবই জঘন্য অপরাধ না হলে এক জন অভিযুক্তের জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রথম বার অভিযুক্তদের জামিন নিয়ে বিবেচনা করতে বলেছে। এই রায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।’’
হাই কোর্টের আইনজীবী ফিরদৌস শামিম অবশ্য মনে করেন, পার্থ-অর্পিতার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কার্যকর না-ও হতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘দু’জনের বিরুদ্ধেই একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে আর্থিক দুর্নীতি, প্রতারণার অভিযোগও। তাঁরা একাধিক অপরাধ করেছেন। দু’জনেই এসএসসি এবং প্রাথমিক দুই ক্ষেত্রেই দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত। তাঁরা সহজে জামিন পাবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।’’