আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে মেয়েদের রাতদখল। —নিজস্ব চিত্র।
স্বাধীনতার মধ্যরাতে নারী স্বাধীনতার জন্য ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছিল প্রথমে শহরের তিন জায়গায়। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড এবং কলেজ স্কোয়্যার। সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল কার্যত গোটা বাংলা। তার ফলে গোটা রাজ্যের ছবিটা পাল্টে গেল বুধবার মাঝরাতে। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি, কৃষ্ণনগর থেকে মেদিনীপুর— রাজপথ দখল করে নিলেন মেয়েরা। পাশে কোথাও কোথাও রইলেন পুরুষরাও। এ ভিন্ন এক বঙ্গ দর্পণ। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে কর্তব্যরত এক চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ এবং খুনের প্রতিবাদেই এই কর্মসূচি। কিন্তু এই প্রতিবাদ কর্মসূচি চলাকালীন সেই আরজি করেই হামলা চালানো হল। ভাঙচুর চালানো হল জরুরি বিভাগে। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘নীরব দর্শক’ পুলিশও আক্রান্ত হল। ভেঙে দেওয়া হল আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মঞ্চ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামানো হল র্যাফ। চালানো হল কাঁদানে গ্যাস। অন্য দিকে, যাদবপুরের কর্মসূচিতে দুই প্রতিবাদী মহিলাকে ধাক্কা দেওয়ার অভিযোগ উঠল পুলিশের বিরুদ্ধে। তা নিয়ে রাতভর থানার সামনে ও যাদবপুর থানা মোড়ে চলল অবস্থান বিক্ষোভ।
মধ্যরাতের সন্ধিক্ষণে স্বাধীন হয়েছিল দেশ। ৭৭ বছর আগে। ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসে বাংলা জুড়ে মেয়েদের স্বাধীনতার এক অনন্য গল্প রচিত হল। কলকাতা শহরে, প্রথম সারির হাসপাতাল আরজি করে এক মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় আলোড়িত জনমানস। রাত দখল করলেন মেয়েরা। নারীদের ডাকা আন্দোলনে পুরুষেরাও রইলেন বটে, কিন্তু প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েই তা হল।
রাত ১১টা ৫৫ মিনিট থেকে কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা ছিল। মোদ্দা কথা, মধ্যরাতের স্বাধীনতার সেই সন্ধিক্ষণের খানিক আগে মেয়েরা ‘রাতের দখল’ নেবেন এমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু ‘অভিধানহীন’ আবেগ সন্ধ্যার পর থেকেই একটু একটু করে জমতে শুরু করেছিল ইতিউতি। যাদবপুর থেকে চন্দননগর। কলেজ স্ট্রিট থেকে সোনাগাছি। মশাট থেকে উত্তরপাড়া। কিছু জায়গায় ইতিমধ্যেই জমায়েত নজর কাড়ার মতো।
রাত ৯টার আগে থেকেই যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডে ভিড় বাড়তে শুরু করে মেয়েদের। গত ১০ অগস্ট রাতে ফেসবুকে পোস্ট করে মেয়েদের রাত দখলের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী রিমঝিম সিংহ। ক্রমে ক্রমে তা আন্দোলনের রূপ নেয়। সেই রিমঝিমও রাত ৯টার খানিক আগে ৮বি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছিলেন। হাতে সাতরঙা পতাকা। কপালে বেগনি ফেট্টি। রিমঝিম বলেন, ‘‘এই বিপুল সাড়া প্রমাণ করে যে, আমাদের সকলের মধ্যেই ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই আমরা জড়ো হয়েছি। বিচার তো আমরা অবশ্যই চাইব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। মূলে গিয়ে শোষণের প্রত্যেকটা কারণকে তুলে ধরা দরকার।’’
এই কর্মসূচি ‘রাজনৈতিক না অরাজনৈতিক’, সেই বিতর্কে রিমঝিমের জবাব, ‘‘আমি প্রথমে যখন এটার ডাক দিয়েছিলাম, এতটা সাড়া পাব ভাবিনি। কিন্তু এত সাড়া পাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে, অনেকে চেষ্টা করবেন এই প্রচেষ্টাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার, নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার। সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি বরাবর সেই চেষ্টাই করেছে। আমি বলেছিলাম, এখানে কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকার ঠাঁই নেই। যে হেতু এটা নারী স্বাধীনতার আন্দোলন, প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার পরিচয়ের মানুষদের স্বাধীনতার আন্দোলন, তাই তাঁদের রাজনীতির পতাকাই এখানে জায়গা পাবে। এটার সঙ্গে সংসদীয় রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। এটা বিকল্প ধারার রাজনীতি। জনগণের মত নিয়ে চলার রাজনীতি। ’’
যাদবপুরের মতো কলেজ স্কোয়্যার ও অ্যাকাডেমি চত্বরেও ভিড় বাড়তে থাকে তত ক্ষণে। শুধু এই শহরের তিন কেন্দ্রই নয়, সল্টলেক, বেহালা, গড়িয়া, শ্যামবাজারেও মিছিল বেরিয়েছিল। কর্মসূচি ছিল আরজি কর হাসপাতালের সামনে থেকেও। নির্ধারিত সময়ে সেখানেও মিছিল শুরু হয়। ঠিক তার পরেই ওই হাসপাতালে হামলার ঘটনা ঘটে। মধ্যরাতে শহরে মেয়েদের রাতদখলের কর্মসূচির মধ্যে কারা হামলা চালালেন আরজি কর হাসপাতালে? এখন এই প্রশ্নই সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় বুধবার রাজ্য জুড়ে যখন প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, সেই সময় আরজি করে আচমকাই আক্রমণ কি পরিকল্পনা করেই করা হল? এখনও অজানা এই প্রশ্নের উত্তরও। কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলের কাছে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর্জি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাতে দোষীদের খুঁজে বার করা হয়। বিরোধীরা অবশ্য গোটা ঘটনায় তৃণমূলেরই হাত রয়েছে বলে মনে করছেন।
হামলার ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন পুলিশ কমিশনার। এলাকা ঘুরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ‘ক্রুদ্ধ’ বিনীত বলেন, ‘‘ডিসি নর্থ প্রতিবাদকারীদের রক্ষা করতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। এখানে যা হয়েছে তা ভুল প্রচারের জন্য। কলকাতা পুলিশ এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।’’
আরজি করে হামলার ঘটনার পরেই ক্ষোভ আছড়ে পড়ে রাতদখলের মিছিলগুলিতে। যাদবপুরে পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান মিছিলে থাকা মেয়েরা। সেই সময় দুই মহিলাকে ধাক্কা দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এর প্রতিবাদে গভীর রাতে যাদবপুরে অবস্থানে বসেন প্রতিবাদীরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সোহিনী সরকার, উষসী রায়, সৌরসেনী সরকার, তনিকা বসু-সহ টলিউডের অনেকে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ভোর ৫টা নাগাদ অবস্থান তুলে নেন তাঁরা।
জেলায় জেলায় অবশ্য বুধবার সন্ধ্যা থেকেই কর্মসূচি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় চুঁচুড়া ডিআই অফিসের সামনে থেকে শুরু হয় মিছিল। শেষ হয় ইমামবাড়া হাসপাতালের সামনে ছাতিমতলায়। হুগলির চণ্ডীতলাতেও মিছিল হয়েছে। চন্দননগরের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন এভারেস্ট জয়ী পিয়ালী বসাক। সন্ধ্যাতেই মেয়েদের দখলে চলে গিয়েছিল রাজপুরের কালীতলা থেকে হরিনাভি এনএসবোস রোড। মুখে স্লোগান, ‘বিচার চাই’। কলেজ পড়ুয়া তরুণী থেকে শুরু করে সাধারণ গৃহবধূ ও পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলারাও হেঁটেছেন মিছিলে। এই মিছিলে পা মিলিয়েছেন সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীও। রাত ১০টা থেকে শিলিগুড়িতে শুরু হয় মহিলাদের মিছিল। শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতাল পেরিয়ে সফদর হাসমি চক হয়ে মিছিল শেষ হয়। বর্ধমানে কার্জনগেটের সামনেও মেয়েদের বিশাল জমায়েত হয়। মিছিল হয় রাজ্যের সব ছোটবড় শহরেও।