পেঁয়াজের ঝাঁজ সামলাতে নাজেহাল মধ্যবিত্ত।— ফাইল চিত্র।
বাজার থেকে বেজার মুখে বাড়ি ফিরেছিলেন অনন্ত সোম। বাড়িতে কয়েক জন অতিথি আসবেন। একটু ভালমন্দ রান্না হবে বলে স্ত্রী গীতাদেবী তাঁকে বেশি করে পেঁয়াজ আনতে বলেছিলেন। কিন্তু অনন্তবাবু মাত্র পাঁচশো পেঁয়াজই কিনতে পেরেছেন। মাছ-মাংস কেনার পর ওর বেশি আর কিনতে পারেননি। আর তাতেই চটেছেন গীতাদেবী।
স্ত্রীকে সামলাতে শেষমেশ কিছুটা চিৎকারই করতে হয়েছে অনন্তবাবুকে। বলতে হয়েছে, “বাজারে তো যাও না। পেঁয়াজের দাম কত হয়েছে জানা আছে?’’ বুধবার পেঁয়াজকে কেন্দ্র করে সাংসারিক এই কলহের কথাই শোনাচ্ছিলেন হালতুর বাসিন্দা ওই প্রৌঢ়।
সাতসকালে বাজারে যাওয়া অনেক দিনের অভ্যেস সখেরবাজারের বাসিন্দা শান্তনু মজুমদারের। বুধবার বাজারে গিয়ে শান্তনুকে এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে ৭০ টাকায়। গত সপ্তাহে ৫৫-৬০ টাকা ছিল। শান্তনুর বক্তব্য, “যদি এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে গিয়েই ৭০ টাকা চলে যায়। তা হলে আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা খাবে কী?”
আরও পড়ুন: তৃণমূলে কঠোর, বিরোধীতে নরম কেন? প্রশাসনিক সভায় পুলিশকে কড়া ধমক মুখ্যমন্ত্রীর
অনেক আড়তদার হু হু করে পেঁয়াজের দাম বাড়ার জন্য রাজ্যের ভূমিকাকেও কাঠগড়ায় তুলছেন। —নিজস্ব চিত্র।
শুধু হালতু বা সখেরবাজারই নয়, কলকাতা হোক বা জেলা— রাজ্যের সব বাজারেই পেঁয়াজ নিয়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। সোদপুর বা রিষড়ার বাজারে আবার বাছাই পেঁয়াজ ৮০ টাকা। যেগুলি বাছাই নয়, সেগুলি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিকোচ্ছে।
কিন্তু আদৌ কী পেঁয়াজের আগুন দাম হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?
কোলে মার্কেট এবং পোস্তা বাজারে আড়তদারা কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তাঁদের দাবি, পেঁয়াজের দাম যে বেড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। নাসিক এবং দক্ষিণ ভারত থেকে যে পেঁয়াজ আসত, তাতে ভাটা চলছে। কিন্তু তা বলে ৬০ বা ৭০ টাকা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। বুধবারও ৪৫ থেকে ৪৬ টাকায় কেজি প্রতি পেঁয়াজ পাইকারি বিক্রি হয়েছে বলে জানান কোলে মার্কেটের আড়তদার বিশাল চন্দ্র। তিনি বলেন, “রাজ্যে প্রতি দিন গড়ে ৬০টি করে ট্রাক ঢুকত। এক একটি ট্রাকে ১৬ টন, কোনওটায় ১৮ টন পেঁয়াজ আসত। কিন্তু সেই জায়গায় রাজ্যে ৪০টি ট্রাক ঢুকছে। কলকাতায় ২০টির বেশি আসছে না। ফলে জোগানে তো ঘাটতি হবেই। তবে ঘাটতি থাকলেও, আড়তদাররা কম বেশি ৪৫ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি করছে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘খুচরো বাজারে এত দাম হওয়া উচিত নয়।”
আরও পড়ুন: ঝুলে রইল রাজীবের ভাগ্য, কাল ফের শুনানি হাইকোর্টে
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পোস্তা বাজারে গদি রয়েছে ব্যবসায়ী গুরুপদ সিংহের। একই সুর শোনা গেল তাঁর মুখেও। তিনি বিশালের সঙ্গে এক মত। তাঁর দাবি, ‘‘কমিশনের ভিত্তিতে পেঁয়াজের কারবার চলে। আমাদের বেশি টাকা দিয়ে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। কিন্তু পেঁয়াজের দাম খুচরো বাজারে এত হবে কেন?’’
ওয়েস্ট বেঙ্গল ভেন্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কমল দে অবশ্য অন্য ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “মহারাষ্ট্রে বৃষ্টি হওয়ার কারণ দেখিয়ে নাসিকের ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এর নেপথ্যে আরও একটি কারণ রয়েছে বলে আমার মত।” তিনি বলেন, “অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সামনে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোট। এই সময় নাসিকের ব্যবসায়ীদের কেউ চটাতে চান না। অনেক ব্যবসায়ীই ভোটের আগে কালোবাজারি করে থাকেন। হঠাৎ দাম বাড়িয়ে দেন। এ বারও তেমন হয়েছে কি না, সেটা দেখা উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের।”
মহারাষ্ট্র ছাড়াও, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ থেকে এ রাজ্যে পেঁয়াজ আমদানি হয়। তা ছাড়া এ রাজ্যের বর্ধমান, হুগলি তো বটেই, এখন রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন হচ্ছে। রাজ্যের এগ্রিকালচার টাস্ক ফোর্সের সদস্যও কমলবাবু। তাঁর দাবি, “বাজারে নজরদারির চালানোর জন্য এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের ভূমিকা থাকাও জরুরি। সেটা ঠিক ভাবে হচ্ছে কি?’’ তাঁর কথায়: ‘‘প্রতি বছর রাজ্যে ৯ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাতেও এখন ভাল ফলন হচ্ছে। কিন্তু সঠিক সংরক্ষণের কোনও পরিকল্পনা না থাকায় সেই ভিন্ রাজ্যের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় আমাদের।” অনেক আড়তদার আবার হু হু করে পেঁয়াজের দাম বাড়ার জন্য রাজ্যের ভূমিকাকেও কাঠগড়ায় তুলছেন।