নৈহাটির বিস্ফোরণ।—নিজস্ব চিত্র।
চিত্র এক: ২০০৬ সালের ঝিটকার জঙ্গল। মাওবাদীদের পোঁতা মাইন ছেনি হাতুড়ি দিয়ে ‘আনাড়ি’র মতো খুলে নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছিল সিআইডির বোমা বিশেষজ্ঞ দল বিডিডিএস-এর দুই কর্মীর। তখনকার মতো অনেক হইচই হয়েছিল। নিচু তলার কর্মীদের দাবি ছিল, বোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিই নেই।
চিত্র দুই: এর সাত বছর পরে ২০১৩-য় আলিপুরদুয়ারে ফের একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সন্দেহভাজন কেএলও জঙ্গিদের ফেলে রাখা আইইডি নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে প্রাণ যায় আরও এক পুলিশ কর্মীর। যদিও তার পরেও ছবিটা বদলায়নি।
চিত্র তিন: ২০১৬ সাল। মালদহের বৈষ্ণবনগরে দেশি বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে প্রাণ যায় সিআইডি-রই দুই আধিকারিকের। গুরুতর জখম হন আরও এক জন।
প্রতিটি ঘটনার পরই যখন উপর তলা থেকে তদন্ত হয়েছে, জানা গিয়েছে, বোমা নিষ্ক্রিয়করণে বিশেষজ্ঞরা ছিলেন বেপরোয়া। পুলিশি ভাষায় যাকে বলে, ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর’ (এসওপি) তা মানেননি ওই কর্মীরা। প্রয়োজনীয় সতর্কতা ছাড়াই বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিপত্তি হয়েছে। প্রাণ দিয়ে সেই মূল্য চোকাতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নৈহাটিতে বাজেয়াপ্ত বেআইনি বাজি নিষ্ক্রিয়করণের দায়িত্বেও ছিলেন রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডির তিন সদস্য। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট বা সিআইডির শীর্য কর্তারা ঘটনার পর থেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। জনরোষের শিকার হয়ে নিগৃহীত হয়েছেন ওই বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন: বাজি নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে তীব্র বিস্ফোরণ, নৈহাটি-চুঁচুড়া জুড়ে আতঙ্ক-উত্তেজনা
তবে এ ক্ষেত্রেও যে বোমা নিষ্ক্রিয় করার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীরা প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করেননি, তা স্পষ্ট ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বয়ানেই। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘নৈহাটির ছাইঘাটে এ দিন দুপুরে বস্তা বন্দি করে প্রচুর পরিমাণ বাজি এবং বাজি তৈরির মালমশলা নিয়ে আসেন পুলিশকর্মীরা। তার পর খুব দায়সারা ভাবে একটা দড়ির ডগায় অল্প বিস্ফোরক বা আগুন দিয়ে সরে আসা জমা বাজি থেকে। দূর থেকে দড়ি টানলে আগুন গিয়ে পড়বে জমা বাজিতে। তাতেই ফেটে এবং জ্বলে নষ্ট হবে ওই বেআইনি বাজি।
আর এখানেই আপত্তি তুলেছেন, সিআইডির বম্ব ডিটেকশন অ্যান্ড ডিজপোজাল শাখার দায়িত্বে এক সময় থাকা এক পুলিশ আধিকারিক। তিনি বলেন, ‘‘আমি দায়িত্বে থাকার সময় ওই শাখার জন্য প্রচুর নতুন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল। এই ভাবে বাজি পোড়ানো পুরোপুরি নিয়মের বিরুদ্ধে।” তিনি বলেন, ‘‘প্রথমেই দরকার ছিল বালির বস্তা দিয়ে ঘেরা। প্রয়োজনে মাটিতে গর্ত বা ট্রেঞ্চ কাটা। তার পর বালির বস্তা দিয়ে ঘেরা। যাতে অভিঘাত কম হয়।” তিনি ব্যাখ্যা করেন, বিপদ এ ভাবেই লুকিয়ে থাকে। ‘‘তাঁর কথায়, যখন বাজির মশলা জড় করা হচ্ছে, তখন কেই জানে না ওই মশলার মধ্যে সাধারণ বাজির মশলা ছাড়া অন্য কোনও রাসায়নিক রয়েছে কি না? ফলে যে কোনও সময় আন্দাজের থেকে অপ্রত্যাশিত বেশি অভিঘাত হতেই পারে। ঠিক যেমনটা হয়েছে বৃহস্পতিবার। নিয়ম মেনে করলে সেই অপ্রত্যাশিত অভিঘাতও সামাল দেওয়া যায়।’’
আরও পড়ুন: সুজাপুরের ঘটনার তদন্তে সিআইডি, গঠিত হবে বিশেষ দল
ব্যারাকপুরের কমিশনার মনোজ বর্মাও এ দিন স্বীকার করে নেন যে, এর আগেও তিন দিন ওই পদ্ধতিতেই বাজি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। কিন্তু এ রকম মারাত্মক তীব্রতা তাঁরা আশা করেননি। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয় এসওপি মানা হয়েছিল কি না, জবাবে তিনি বলেন, ‘‘নিষ্ক্রিয় করার দায়িত্বে ছিলেন সিআইডির দল। তাঁরাই বলতে পারবেন।”
যদিও সিআইডির এক শীর্ষ কর্তার দাবি, সিআইডি-ক সঙ্গে ছিল কমিশনারেটের দলও। অর্থাৎ যুগ্ম দল। সিআইডির এক আধিকারিক স্বীকার করেন, বৃহস্পতিবারের ঘটনা ফের এক বার প্রমাণ করল,একটু নিয়ম মেনে সতর্ক হলেই এত বিতর্ক এড়ানো যেত।
দায় কার সে নিয়ে বিতর্কের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়েছে অন্য এক বিতর্কও। কয়েক দিন আগে দেবকে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পর স্থানীয় বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহ দাবি করেছিলেন যে, শাসক দলের মদতে এ রকম বেআইনি বাজি কারখানায় বোমা তৈরি করা হচ্ছে। এ দিন তাঁর কথার সুর ধরেই বিজেপি নেতা মুকুল রায় টুইট করে বলেন, ‘‘মানুষ বোকা নয়। ওই বিস্ফোরণের অভিঘাত থেকেই স্পষ্ট বাজি নয়, বোমা ছিল। এই জমানায় তৈরি হয়েছে বোমা তৈরির কারখানা।”