গঙ্গাসাগর শিবিরে বৃদ্ধা সুকানি বাই। —নিজস্ব চিত্র
সাগরস্নানের সময় হাত ধরে ছিল ছেলে। স্নানের শেষে এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে কিছু জিনিসও কিনেছিল এক হাতে মাকে ধরে রেখে। কিনে দিয়েছিল একটা সোয়েটারও। সেই ছেলেই হাত ছাড়িয়ে চলে যাবে, এটা রাত পর্যন্ত মানতে পারছিলেন না অশীতিপর সুকানি বাই।
বিহারের গয়া জেলার দুপারিয়া গ্রামে বাড়ি সুকানিদেবীর। স্বামী মুকন্দিলালের সঙ্গে মকরসংক্রান্তিতে সাগরস্নানে এসেছেন বহু বার। স্বামীর মৃত্যুর পরে আর আসা হয়নি। এ বার বড় ছেলে ও বৌমার ইচ্ছেতেই সংক্রান্তির স্নান করতে আসা। ছেলে এত যত্ন করে নিয়ে এলেও আচমকা কোথায় হারিয়ে গেল, খুঁজেই পাননি বৃদ্ধা। তার পর থেকে ঠায় বসে ছিলেন সাগরে পাঁচ নম্বর রাস্তায়।
হ্যাম রেডিয়ো অপারেটরেরা খবর পান বৃহস্পতিবার রাত ১১টা নাগাদ। সুকানিদেবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর তিন ছেলে, চার মেয়ে। বড় ছেলে ধনসিংহের সঙ্গে তিনি এ বার গঙ্গাসাগরে এসেছিলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছেলে সঙ্গেই ছিল। একসঙ্গে খেয়েছেন তাঁরা। ছেলের কাছে একটু জল চেয়েছিলেন। রাস্তায় তাঁকে দাঁড় করিয়ে সেই যে ধনসিংহ উধাও হয়ে গেলেন, আর ফিরে আসেননি।
গঙ্গাসাগরে এমন ঘটনা নতুন নয়। ফি-বছর বয়স্ক বাবা-মাকে মেলায় ফেলে রেখে চলে যান সন্তানেরা। কেউ হাসপাতালে, কেউ হোমে থাকেন। হ্যাম রেডিয়োর অপারেটরেরা খুঁজে বার করেন অনেকের বাড়ি। তার পরে চলে ফেরানোর পালা। কিন্তু যাঁরা বাবা-মাকে ফেলে যান, তাঁরা কি ফিরিয়ে আদৌ যত্ন করে রাখে তাঁদের?
গঙ্গাসাগরের অস্থায়ী হাসপাতালে সুকানিদেবীর প্রাথমিক চিকিৎসার পরে গয়া পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওয়েস্টবেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাব। বুদ্ধগয়ার দুই হ্যাম রেডিয়ো অপারেটর যান বৃদ্ধার গ্রামে। যোগাযোগ করা হয় তাঁর এক মেয়ে শান্তি বাইয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘সম্পত্তির ভাগ নিয়ে বড়দার আপত্তি ছিল। এখানে মেয়েদের সম্পত্তি দেওয়া হোক, তা অনেকে চান না। কিন্তু বাবা আমাদের সব ভাই বোন আর মাকে সমান ভাগে সম্পত্তি দিয়েছিলেন। বড়দা ও বৌদি অনেক বারই মাকে বাড়ি থেকে বার করে দিতে চেয়েছিল। এ বার ফেরার পথেও দাদাকে ফোন করায় বলে, মা সঙ্গে আছে। কিন্তু মিথ্যা বলেছিল।’’
ধনসিংহের ফোন বন্ধ। শান্তির কাছ থেকেই খোঁজ মেলে মধ্যপ্রদেশের লক্ষ্মীনগরের অর্জুন সিংহের। যিনি সুকানিদেবী ও ধনসিংহ-সহ মোট ৫৭ জনকে বাসে করে গঙ্গাসাগরে এনেছিলেন। রাতেই তাঁকে ফোন করেন ওয়েস্টবেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের সেক্রেটারি অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস। বাস তখন সবে কাকদ্বীপ ছাড়িয়েছে।
অম্বরীশবাবু বলেন, ‘‘অর্জুনের ফোনে ধনসিংহকে ধরা হলে উনি আমাদেরও মিথ্যা বলেন। বলেন, মা ওঁর সঙ্গে আছেন। তার পরেই বাস কচুবেড়িয়ার দিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলি চালককে। সুকানি বাইকে নিয়ে আমরা নদী পেরিয়ে বাসের কাছে যাই। গয়ার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলি এবং বৃদ্ধা ফিরে গিয়ে যাতে নিরাপত্তা পান, সেটা দেখতে অনুরোধ করি।’’ ‘‘এটা খুবই চিন্তার বিষয়। বৃদ্ধার পরিবারকে জানানো হয়েছে, উনি ফেরার পরে পরিবারের সদস্যদের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। ওঁর সুস্থতার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে,’’ বলেন গয়ার সিনিয়র পুলিশ সুপার আদিত্য কুমার।