চাষের দিশা

নীরোগ চারার জন্য যত্নে বীজতলা তৈরি

বীজতলা হল নতুন সব্জি ফসলের আঁতুড়ঘর। তাই এটিকে সুন্দর ভাবে তৈরি না করতে পারলে ভাল ফলন পাওয়া কঠিন। মাটি পরিষ্কার: বীজতলার নির্ধারিত জায়গাটি এক থেকে দুই ফুট গভীর খুঁড়ে নুড়ি পাথর, আগাছা সরিয়ে ভাল করে রোদ খাইয়ে নিতে হবে প্রথমে।

Advertisement

শুভদীপ নাথ

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৬ ০০:৫৭
Share:

বীজতলা হল নতুন সব্জি ফসলের আঁতুড়ঘর। তাই এটিকে সুন্দর ভাবে তৈরি না করতে পারলে ভাল ফলন পাওয়া কঠিন।

Advertisement

মাটি পরিষ্কার: বীজতলার নির্ধারিত জায়গাটি এক থেকে দুই ফুট গভীর খুঁড়ে নুড়ি পাথর, আগাছা সরিয়ে ভাল করে রোদ খাইয়ে নিতে হবে প্রথমে।

বেড তৈরি: মাটি কুপিয়ে মিহি ও সমান করে মূল জমিতল থেকে ৬-৮ ইঞ্চি উঁচু করে বীজতলার বেড বানান। মাঝখানটা উঁচু ও ধারগুলি সামান্য ঢালু, অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মতো হবে।

Advertisement

নিকাশিনালা: বীজতলার ধার দিয়ে এক থেকে দেড় ফুট গভীর নালা কেটে জলনিকাশির ব্যবস্থা রাখতে হবে।

দৈর্ঘ্য-প্রস্থ: বীজতলা চওড়ায় তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট বা এক মিটার করলে পরিচর্যার সুবিধা হয়। এতে এক ধারে বসে হাত বাড়িয়ে অন্য ধার অবধি পৌঁছনো যায়। লম্বা কতটা হবে, নিজের সুবিধা বুঝে করা ভাল।

পলিছাউনি-মশারি: বর্ষাকালে বীজতলা তৈরির একটা প্রধান কাজ হল উপরে পলিথিনের আচ্ছাদন দেওয়া। সাধারণত চাষিরা বাঁশের বাতা অর্ধচন্দ্রাকারে বাঁকিয়ে দুই-তিন ফুট উচ্চতায় স্বচ্ছ পলিথিনের ঢাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এতে ঠিকমতো হাওয়া চলাচল করতে পারে না বলে ভিতরে ভ্যাপসা হয়ে চারা ঢলে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই পাশাপাশি একাধিক বীজতলা বানিয়ে পুরোটা একসঙ্গে উঁচু করে স্বচ্ছ পলিথিনে ঢাকার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল। এর সঙ্গে যদি বীজতলার ধার ৪০ বা ৫০ মেশের কীট প্রতিরোধকারী মশারির জাল দিয়ে দিয়ে ঘিরে দেওয়া যায়,তাহলে শোষক পোকার হাত থেকে রক্ষার সঙ্গে ভাইরাস রোগ অনেকটা প্রতিহত হবে। প্রতি স্কোয়ার মিটার কীট প্রতিরোধী মশারির দাম ৪০ টাকা এবং ২০০ মাইক্রন পলিছাউনি প্রতি বর্গমিটার ৭৫ টাকা দরে কিনতে পাওয়া যায়। এই রকম একটা কাঠামো বানিয়ে রেখে দিলে দরকার মতো এখানে চারা বানিয়েও বিক্রি করতে পারবেন চাষিরা। বর্ষাকাল বাদে অন্য সময়ে যখন পলিছাউনি দেওয়ার প্রয়োজন থাকবে না, তখন বেডের চারদিকে শুধু উপরে মশারির মতো ৪০-৫০ মেশের কীট প্রতিরোধী নেট লাগালে প্রাথমিক ভাইরাস রোগ প্রতিহত করা সম্ভব হবে।

বীজতলা শোধন: সুস্থ-সবল চারা পাওয়ার জন্য বীজ শোধন যেমন জরুরি, তেমনই তার আঁতুড়ঘর বীজতলার মাটিও শোধন করা দরকার। আবহাওয়া, সময়, মাটি প্রভৃতি ভেদে তিন-চার রকমে এটা করা যায়—

গরমের সময় যখন তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর চলে যায়,তখন বীজতলার কাজ শুরু করলে সূর্যের তাপের সাহায্যে মাটি শোধন করা যাবে। বীজতলা তৈরি করার পর ২০০ গেজের স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে পুরো বীজতলা ঢেকে দিতে হবে। পলিথিনের ধারে ভেজা মাটি চাপা দিয়ে হাওয়া ঢোকার জায়গা বন্ধ করে ও পলিথিন হাওয়াতে যাতে উড়ে না যায়, তার বন্দোবস্ত করে ৫-৬ সপ্তাহ ঢেকে রাখতে পারলে তাপীয় শোষণ দ্বারা বীজতলার মাটি শোধন হবে।

এত দিন মাটি ঢেকে রাখার সময় না পেলে অল্প দিন জমি ঢেকে রাখার সঙ্গে জৈব বা রাসায়নিক উপায়ে মাটি শোধন করতে হবে। রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৩ মিটার x ১ মিটার বীজতলায় ২০ মিলি ফরমালিন (৩৫-৪০%) ১০-১৫ লিটার জলে মিশিয়ে ঝারি দিয়ে বীজতলার মাটির ১০ সেমি উপরিভাগ সমান ভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। এরপর স্বচ্ছ পলিথিন বা ভেজা চট বা কলাপাতা দিয়ে ২-৩ দিন ঢেকে রাখতে হবে। আচ্ছাদন তুলে আর এক বার কুপিয়ে মাটি মিহি করে, জৈব ও অজৈব সার মিশিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিলে মাটি বীজ বোনার উপযুক্ত হবে।

মাটি ঢাকার সময় না পেলে ও শুধু রাসায়নিক দ্বারা বীজতলার মাটি শোধন করতে চাইলে প্রতি লিটার জলে ৪ গ্রাম কপার অক্সিক্লোরাইড গুলে বীজতলার মাটি ভাল ভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। ৩-৪ দিন পরে মাটি কুপিয়ে মিহি করে ব্যবহার করা যাবে। তবে আরও ভাল শোধিত বীজতলা পেতে চাইলে রাসায়নিক স্প্রে দেওয়ার পর এক সপ্তাহ স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। পরে ঢাকা তুলে মাটি কুপিয়ে দিলে আরও এক সপ্তাহ পরে ভাল শোধিত বীজতলা পাওয়া যাবে।

সবচেয়ে ভাল হয় জৈব রোগনাশক দিয়ে মাটি শোধন করতে পারলে। এক্ষেত্রে ১০-১৫ দিন স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে পুরো বীজতলা ঢেকে দিতে হবে। ৩ মিটার x ১ মিটার বীজতলার জন্য ২০কেজি জৈব সার বা ১০ কেজি কেঁচো সারের সঙ্গে ১৫০ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি/ হার্জিয়ানাম ও ১৫০ গ্রাম সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স এক সপ্তাহ আগে মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে রেখে পরে বীজতলায় মিশিয়ে মাটি কুপিয়ে দিতে হবে। জৈব সারের পরিমাণ কিছুটা কম-বেশি হলে ক্ষতি নেই। তবে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৫০ গ্রাম করে ট্রাইকোডার্মা ও সিউডোমোনাস হিসাব করে কিছু দিন আগে মিশিয়ে বীজতলার মাটিতে দিতে পারলে ভাল ভাবে মাটিবাহিত রোগ (ধসা, চারা ঢলে পড়া) প্রতিরোধ করা যাবে।

অবশ্যই জৈব সার: জৈব সারের সঙ্গে জৈব রোগনাশক দিয়ে মাটি শোধন করতে না পারলেও অন্য উপায়ে মাটি শোধনের পর জৈব সার কিছুটা দিতেই হবে। সাধারণত ৩ মিটার x ১ মিটার বীজতলায় ২০ কেজি শুকনো গোবর সার বা ১০-১৫ কেজি কেঁচো সার, ২৫০ গ্রাম সুপার ফসফেট ও ৫০ গ্রাম মিউরিয়েট অফ পটাশ প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভাল ভাবে মিশিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে।

লেখক: সহ উদ্যানপালন অধিকর্তা, মুর্শিদাবাদ। যোগাযোগ: ৯৪৭৪৫৭৮৬৭১।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement