সে দিনের তিনি আর এ দিনের তিনিতে কত তফাত!
সে দিনের তিনি বিরোধী নেত্রী হিসেবে বলতেন, ক্ষমতায় এলে দলতন্ত্রের কব্জা থেকে শিক্ষাকে মুক্তি দেবেন। মহাকরণের চেয়ারে বসার পরেও কিছু দিন তাঁর সেই লক্ষ্য অটুট ছিল। কিন্তু এখন? তাঁরই শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভায় বিল এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা পুরোদস্তুর সরকারি হাতে নিতে উদ্যত হচ্ছেন! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মত বদলানোয় শেষ মুহূর্তে সেই প্রয়াস আটকে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু শিক্ষার সর্ব স্তরে দলতন্ত্রের সিলমোহর বসানোর প্রক্রিয়াটি আরও বেআব্রু হয়ে গিয়েছে! অভিযোগ, এমন উল্টো যাত্রায় মমতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো সৈনিকেরাই!
মমতা ১ এবং মমতা ২ যেন পরিষ্কার দুই ভাগে ভেঙে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ইনিংস! প্রথম পর্বে বামফ্রন্ট সরকারের থেকে নিজেকে আলাদা করতে তিনি শিক্ষায় মুক্ত হাওয়ার পন্থী। সংস্কারের প্রয়াসী। সদ্য ক্ষমতায় এসে তাই তিনি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে যথার্থ স্বশাসন দিতে উদ্যোগী হন, তার জন্য মেন্টর গ্রুপ গড়েন। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে থেকে আসা ব্রাত্য বসুকে।
কিন্তু সেই পর্ব দীর্ঘস্থায়ী নয়। দ্বিতীয় পর্বে মমতা শিক্ষাক্ষেত্রকে কুক্ষিগত করতে উদ্যত। তাই শিক্ষা দফতরে নিয়ে আসেন পার্থবাবুর মতো পুরোদস্তুর রাজনীতিককে। শিক্ষায় উৎকর্ষের চিন্তাকে পিছনে ঠেলে এগিয়ে আসে তৃণমূল-রাজ, অনেকের মতে যার তুলনায় বাম জমানার ‘অনিলায়ন’ও নেহাতই শিশু! উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত সর্বশেষ সংশোধনী বিলের উদ্যোগ এই পরিবর্তনের পরিবর্তন-পর্বেরই সর্বশেষ উদাহরণ।
শেষ প্রহরে শিক্ষামন্ত্রীর উপাচার্য-নিয়ন্ত্রক হওয়ার উদ্যোগ অবশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন তাঁর দলেরই একাংশ। তাঁরাও মনে করেন, এই বিল সত্যিই পাশ হলে শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগৎ-সহ সাধারণ নাগরিক সমাজের কাছে মুখ দেখানোর উপায় থাকত না রাজ্য সরকারের! বিধানসভায় বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে নোটিস দিয়েও তাই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি লজ (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল, ২০১৪’ আপাতত প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। তবে এই সূত্রেই প্রশ্ন উঠছে, শেষ পর্যন্ত পার্থবাবুর উদ্যোগে মুখ্যমন্ত্রী জল ঢাললেন কেন?
তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, এমন মোটেই নয় যে পার্থবাবুর মস্তিষ্কপ্রসূত ওই বিল সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী কিছুই জানতেন না। যে দফতরেরই বিল আসুক, তা অবহিত করতে হয় মন্ত্রিসভাকে। এই বিলের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। এবং মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতিও আদায় করে নিয়েছিলেন পার্থবাবু। তা হলে শেষ মুহূর্তে কেন মত বদলালেন মমতা? এক প্রবীণ মন্ত্রীর কথায়, “অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রীর নিজস্ব পরিচিতির একটা বৃত্ত আছে। ওই বিলের কথা জেনে শিক্ষা জগতের কিছু ব্যক্তিত্ব তাঁকে বলেন, এই কাজ করলে শিক্ষায় স্বশাসন বলে আর কিছু থাকবে না! তা ছাড়া, ইউজিসি-র রীতিনীতির সঙ্গেও এমন ভাবনা খাপ খায় না। তখনই তিনি নির্দেশ দেন, এই বিল নিয়ে এগোনোর দরকার নেই।”
এই বিল পাশ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে রাজ্যপালের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হতো। রাজ্য সরকারের পছন্দে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর বসানো ছাড়া তাঁর আর কিছু করণীয় থাকত না! শিক্ষামন্ত্রীর অবশ্য আত্মবিশ্বাস ছিল, রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর যা ‘সম্পর্ক’, তাতে রাজভবন থেকে বিশেষ কিছু আপত্তি উঠবে না! কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত সেই রাস্তায় হাঁটেননি! পার্থবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের অবশ্য বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী তো গোটাটাই জানতেন! বিল পেশ বা প্রত্যাহার, সবটাই হয়েছে তাঁর অনুমোদন ভিত্তিতে।”
তবে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সূত্রেই আরও একটি পরিবর্তন নজরে আসছে তাঁর দল ও প্রশাসনের একাংশের। মমতা-১ যুগের দস্তুর ছিল, মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে যা বলেন, একান্তেও তা-ই। কিন্তু মমতা-২ যুগে প্রকাশ্য অবস্থান আর অন্তরালের পদক্ষেপের মধ্যে কোথাও একটা তফাত চোখে পড়ছে। এই মমতা প্রকাশ্যে বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুব্রত মণ্ডলের পিঠ চাপড়ে দেন ‘দক্ষ সংগঠক’ বলে। কিন্তু একান্তে নবান্নে ডেকে সেই অনুব্রতকেই মৃদু ভর্ৎসনা সহযোগে সমঝে দেন, বেশি বাড়াবাড়ি না করতে! শঙ্কুদেব পণ্ডা আন্দোলনের নামে শিক্ষাঙ্গনে ত্রাস ছড়ালেও এই মমতা প্রকাশ্যে তাঁকে তিরস্কার করেন না, কিন্তু নিঃশব্দে সরিয়ে দেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতির পদ থেকে। এই মমতা প্রকাশ্যে আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না। কিন্তু তাঁরই নির্দেশ মেনে ভাঙড়ের প্রাক্তন বিধায়ককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও আরাবুল-কাণ্ডে দলের পদক্ষেপের আন্তরিকতা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই প্রশ্ন আছে। কারণ, আরাবুলের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা হয়নি। ভাঙড় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকেও তাঁকে সরতে বলা হয়নি। বরং বিধানসভায় পঞ্চায়েত আইনের সংশোধনী বিল (আজ, শুক্রবারই সেই বিল নিয়ে আলোচনা) এনে তাঁর পদে থাকার মেয়াদ আরও নিশ্চিত করা হচ্ছে!
এবং এই সূত্রেই চর্চা হচ্ছে, আগের মমতা হলে হয়তো উপাচার্য নিয়োগে এমন সংশোধনী তৈরিই হতো না! তখন মুখ্যমন্ত্রী তুলনামূলক ভাবে বেশি বিশ্বাসী ছিলেন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তায়। সব কলেজে একত্রে অনলাইন ভর্তির কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার ভাবনার বীজ তখনকারই। কিন্তু তাতে অসুবিধা হয়ে যাচ্ছিল ‘শঙ্কুস্যার’দের। ব্রাত্য-বিদায়ের পরে শিক্ষা দফতরে এলেন পার্থ। সংস্কারও প্রায় ব্রাত্য হয়ে গেল! নতুন শিক্ষামন্ত্রীর প্রথম বছরে সার্বিক অনলাইন ভর্তি আর হল না। যাদবপুর-সহ একাধিক শিক্ষাঙ্গনে চূড়ান্ত অপদস্থ হল সরকার। দায়িত্ব থেকে সরে যেতে থাকলেন একের পর এক অধ্যক্ষ এবং উপাচার্য। ল্যাজেগোবরে হতে থাকলেন শিক্ষামন্ত্রীও।
শাসক দলেরই একাংশ বলছেন, শিক্ষা জগতে রাজনৈতিক ভাবে নানা মতাদর্শে বিশ্বাসী লোকজন থাকেন। তাঁদের সকলকে নিজস্ব পরিসর দিয়ে চলতে হয়। কিন্তু বাম জমানার ‘অনিলায়ন’কেও ছাপিয়ে গিয়ে আরও বেশি বেশি করে নিজের লোক বসাতে চাইলে যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে। তৃণমূলের এক বিধায়কের কথায়, “যা চাইব তা-ই করতে হবে, আমরা এখন এই রীতিতে ঢুকে পড়েছি। কিন্তু কী চাই, সেটাই ঠিক করে জানি না! সকালে যা চাইছি, বিকেলে চাইছি অন্য। রাতে আবার আর এক রকম চাহিদা হচ্ছে!”
দলেরই আর এক নেতা বলছেন, “আগের শিক্ষামন্ত্রী বিরাট কিছু সংস্কার করছিলেন, এমন নয়। কিন্তু একটা ভারসাম্যের চেষ্টা তাও ছিল। নতুন শিক্ষামন্ত্রী মুখে যা-ই বলুন, কার্যক্ষেত্রে সবই গিয়েছে!”
শিক্ষায় দলতন্ত্রের পথে মমতা-২’র রথে সারথি এখন পার্থ!