গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আগে বোঝা যায়নি শুধু নয়, কেন এমন হল, এখনও তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। দিন দশেক কেটে গিয়েছে উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে, কিন্তু রহস্যের কিনারায় পৌঁছনোর জন্য এখনও ফেলুদার দরকার পড়ছে। এখন যে যা-ই বলুন, ভোটের আগে প্রায় সব শিবিরেরই ধারণা ছিল, তিনটে আসনের মধ্যে গোটা দুয়েক পাবে বিজেপি। একটা পাবে তৃণমূল। কিন্তু ফলাফল দাঁড়াল জোড়াফুল ৩, পদ্মফুল ০। আক্ষরিক অর্থেই তৃণমূলের উঠোনে আগাম পৌষমাস।
কারণ খুঁজতে গিয়ে বেশ কয়েকটা ‘ফ্যাক্টর’-এর কথা উঠে আসছে। প্রথমত, এনআরসি নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, মুসলিম ভোট পুরোটা তৃণমূলের বাক্সে জমা পড়েছে, হিন্দু ভোটও কিছুটা ভেঙেছে, মত বিশ্লেষকদের অনেকের। কিন্তু এই মত মানতে অনেকে আবার রাজিও নন। এনআরসি আতঙ্কই যদি ভোটে বিজেপির হারের কারণ হবে, তা হলে খড়্গপুর সদর আসনে হার হল কেন? তোলা হচ্ছে এই প্রশ্ন।
তেলুগু, হিন্দিভাষী, পঞ্জাবি-সহ বিপুল সংখ্যক অবাঙালির বাস খড়্গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্রে। ৩৫ ওয়ার্ডের পুরসভার পাশাপাশি রয়েছে ৮০ হাজারেরও বেশি জনসংখ্যার রেলওয়ে সেট্লমেন্টও। শহরের বাঙালি বাসিন্দাদের মধ্যে পূর্ববঙ্গীয়দের সংখ্যা নগণ্য। ফলে এনআরসি ইস্যুতে সে ভাবে আতঙ্কের ছাপ পড়েনি খড়্গপুরে।
এ হেন খড়্গপুর সদর প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে কংগ্রেসের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল। ২০১৬ সালে সেখানে প্রথম বার জেতেন বিজেপির দিলীপ ঘোষ। ২০১৯ সালে তিনিই লোকসভা নির্বাচনে লড়েন এবং খড়্গপুর সদর থেকে আরও অনেক বেশি লিড পান। কখনও খড়্গপুরে জিততে না পারা তৃণমূল তা হলে এ বার জিতে গেল কোন মন্ত্রে?
দুটো তত্ত্ব উঠে আসছে খড়্গপুর থেকে। এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামেই যেমন তৃণমূল ভোট পায়, তেমনই রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের একটা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাই তিনি যখন যখন ভোটে দাঁড়িয়েছেন, ভোট পেয়েছেন। তিনি প্রার্থী না হওয়াতে বিজেপি আর ভোট পায়নি।
দুই, খড়্গপুরে ভোট আসলে পেয়েছিল বিজেপি-ই, ব্যক্তি দিলীপ ঘোষ নন। এখন বিজেপির প্রতি জনগণ রুষ্ট, তাই আর আগের মতো ভোট ধরে রাখা গেল না।
আরও পড়ুন: বিজেপি শূন্য, জোড়াফুলের জয়ে অবদান শাহেরও
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তথা রাজনৈতিক বিশ্লেষক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতও অনেকটা মিলছে এই দ্বিতীয় তত্ত্বের সঙ্গে। তিনি বলছেন, তৃণমূলের জয়ের চেয়ে বেশি করে এটা হল বিজেপির হার। বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে তৃণমূল লাভটা ঘরে তুলল বলে তাঁর মত। কিন্তু তৃণমূল তো গত বিধানসভা নির্বাচনেও খড়্গপুরে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল না। লড়াই তো তখনও ছিল কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে। এ বার তৃণমূল প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল কী ভাবে? উদয়নের ব্যাখ্যা, ‘‘খড়্গপুরের মানুষ দীর্ঘ দিন কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। তার পরে বিজেপিতে আস্থা রেখেছেন। কিন্তু হিন্দুত্বের অতিরিক্ত আস্ফালন, অর্থনীতির বেহাল দশা, রেলের বেসরকারিকরণের সম্ভাবনা নিয়ে চর্চা, কাজের বাজার সঙ্কুচিত হওয়া— এ সব নিয়ে বিজেপির প্রতিও মোহভঙ্গ হয়েছে। তাই যে দলকে আগে কখনও ভোট দেননি খড়্গপুরের মানুষ, এ বার সে দলকেই ভোট দিয়ে দিয়েছেন।’’
এখানেই উঠে আসছে দ্বিতীয় ‘ফ্যাক্টর’-এর কথাটা। শুধু এনআরসি নয়, বেহাল অর্থনীতি এবং তার জেরে জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণে বিজেপির ব্যর্থতা, তার জেরে মোহভঙ্গ।
এমনিতে বিজেপির প্রতি এত তাড়াতাড়ি মোহভঙ্গ হওয়ার কারণ পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ছিল না। বিজেপি এখানে বিরোধী দল, তারা এখনও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হয়নি। ফলে ক্ষমতা-বিরোধিতার হাওয়া বিজেপির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়ার কথা নয়। কংগ্রেস এবং বামেরা এখন এ রাজ্যে যে রকম ম্রিয়মান, বিজেপি তা-ও নয়। যথেষ্ট সবল এবং প্রতিবাদী। হয়তো একটু বেশিই। তা সত্ত্বেও যদি বিজেপির বিরুদ্ধে হাওয়া তৈরি হয়, তা হলে সর্বভারতীয় কারণেই যে তৈরি হয়েছে, এ কথা ধরে না নেওয়ার কোনও কারণ নেই।
আরও পড়ুন: এনআরসি করে তাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখালে এমনই হয়: মমতা
আশার যে আলো দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোদী, সে আলো এখন নিভে গিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই এ কথা মনে করছেন। তাঁদের মতে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা না রাখতে পারার কারণেই মোদী ম্যাজিক ফিকে হচ্ছে মূলত। কারণ উন্নয়নশীল দেশে অর্থনীতির ভাল-মন্দের সঙ্গে নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অনেক দিক জড়িয়ে থাকে। জিডিপি বৃদ্ধির হার কমেছে। শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির হার শুধু কমেনি, নেগেটিভে পৌঁছে গিয়েছে। গাড়ি বিক্রিতে বিপুল খরা। নতুন চাকরি নেই। অদূর ভবিষ্যতেই এই পরিস্থিতি বদলে যাবে, এমন কোনও সম্ভাবনাও বিশেষজ্ঞরা দেখছেন না।
বিজেপি তথা কেন্দ্র দাবি করছে, মন্দা শুধু এ দেশে নয়, গোটা বিশ্বে, মন্দা আমেরিকাতেও। আসলে কিন্তু ছবিটা পুরোপুরি সে রকম নয়। আমেরিকায় বরং মন্দা এখনও সে ভাবে আসেনি। এলে তার ধাক্কা আরও বিপুল ভাবে পড়ত ভারতের উপরে।
খড়্গপুরের ক্ষেত্রে উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যাখ্যা সেই একই। প্রথমে বামেদের পক্ষে, পরে কংগ্রেসে, অবশেষে বিজেপিতে আস্থা রাখা কালিয়াগঞ্জও এ বার নতুন কোনও পক্ষকে পরখ করে দেখতে চেয়েছে, কারণ কেউই এখনও আশা পূরণ করতে পারেননি, মত তাঁর। কিন্তু সবে ছ’মাস আগেই তো প্রথম বার বিজেপির উপরে আস্থা রেখেছিলেন কালিয়াগঞ্জ তথা গোটা উত্তরবঙ্গের জনতা। এর মধ্যেই মোহভঙ্গ? দেশের বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা বা জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া কি কালিয়াগঞ্জের মতো গ্রামীণ প্রান্তের উপনির্বাচনে ছাপ ফেলতে আদৌ সক্ষম?
স্থানীয় বাজার বলছে, বেহাল অর্থনীতির ছাপ পড়েনি, আবার পড়েওছে।
উত্তর দিনাজপুরের বিখ্যাত চাল তুলাইপাঞ্জির বাজার এ বারও সরগরম। গত বছরও যা বিক্রি হচ্ছিল কেজি পিছু ৯৫ টাকায়, এ বার তার দাম ১০২ টাকা। এই জেলার চাষিদের জন্য তুলাইপাঞ্জি পেট ভরানোর ফসল নয়, অর্থকরী ফসল। তাই দাম যত বাড়ে, চাষির সমৃদ্ধিও তত বাড়ে।
আরও পড়ুন: রাজ্যে এনআরসি-ধাক্কা কবুল দিলীপ ঘোষের, মানছেন না অমিত শাহ
আর একটা ছবি বলছে, পেট চালানোর বাজারে হাত ছোঁয়াতে পারছেন না সাধারণ জনতা। গোটা দেশের মতো উত্তরবঙ্গেও পেঁয়াজের কিলো ১০০ টাকা ছুঁয়েছে বা পেরিয়ে গিয়েছে। করণদিঘির জনজাতি গ্রাম শীতলপুরে ‘সুরযেপুরি’ ছাড়া অন্য কোনও ভাষা সে ভাবে জানেন না বাসিন্দারা। এমনও আরও অনেক গ্রাম রয়েছে। পড়ন্ত দুপুরে দাওয়ায় বসে রোদ পোহান যে বৃদ্ধা, বাংলায় প্রশ্ন করলে প্রায় কিছুই বুঝতে পারেন না তিনি। হিন্দিও না। কিন্তু ‘পেঁয়াজের দাম’ কথাটা কেটে কেটে উচ্চারণ করলে তিনিও হেসে ফেলেন গ্রামীণ সারল্যে। ভাঙাচোরা বাক্যে জানান যে, পেঁয়াজ অনেক দিন কিনছেন না, দামটা ১০০ টাকা ছুঁয়েছে বলে শুনেছেন।
কালিয়াগঞ্জের রাজবংশী গ্রাম বোচাডাঙায় চাষি শ্যামল সরকারকে চালটা কিনতে হয় না, নিজেদের খাওয়ার মতো ফলিয়ে নেন। মাসকলাইয়ের ডালও জমি থেকেই আসে। কিন্তু তাঁকেও এখন তরি-তরকারি সামান্য কিছু জুটিয়েই চালিয়ে নিতে হচ্ছে। যাঁর নিজের জমি নেই, তাঁর ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেশি। কারণ এক দিকে বাজারদর বেড়েছে। অন্য দিকে কমেছে মজুরির হার। প্লাই মিল, চিনি মিলে কাজ করতে গেলে আগে দিনে অন্তত ২০০ টাকা মিলত। এখন মিলছে ১২০ টাকা, জোর ১৩০ টাকা। মিল মালিকরা বলছেন— ১০০ টাকা করে দিলেও কাজ করতে সবাই বাধ্য, সবার পিছনে বন্ধন লোন।
সেটা কী? বন্ধন মাইক্রো ফিন্যান্স (এখন যা ব্যাঙ্ক) থেকে ঋণ নিয়ে কেউ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, কেউ ঘর বেঁধেছেন। ঘরে ঘরে ঋণ। সপ্তাহান্তে কিস্তি জমা দিতে হয়। খেয়ে-না খেয়ে সে কিস্তি জমা দিতেই হবে। অতএব মজুরি কম বলে না খেটে ঘরে বসে থাকা চলবে না কিছুতেই।
এটা তো ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিরই ছবি। বলছেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু অর্থনীতির তত্ত্ব থেকে বহু দূরে থাকা নিতান্ত সাধারণ গ্রামীণ জনতা কি এত সব বোঝেন? বিশেষত সেই জনতা, যাঁরা ছ’মাস আগেই মোদী হাওয়ায় ভেসে ঝপাঝপ পদ্মফুলে ছাপ মেরেছেন? অর্থনীতির যে বৃহৎ ফ্রেম, গ্রামে গ্রামে দিন গুজরান কঠিন হয়ে ওঠার ছবিটা যে সেই ফ্রেমের বাইরে নয়, সে কথা বুঝে নিয়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল জনতা— এই তত্ত্ব কি খুব জুৎসই?
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তত্ত্ব অবশ্যই জুৎসই। তাঁদের মতে, সাধারণ জনতা এত কিছু বুঝুন বা না বুঝুন, প্রত্যাশা পূরণ যে হচ্ছে না, তা তো অবশ্যই অনুভব করছেন। আর সে অনুভূতিকে ফিকে করে দিতে রোজ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধও করা যায় না। সুতরাং ম্যাজিক ক্রমশ ফিকে হওয়ার পথে। লোকসভা ভোটের আগের বছরেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসের কাছে বিজেপি হেরেছে। কর্নাটকেও গরিষ্ঠতা পায়নি। লোকসভা ভোটের পরে হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে বিধানসভা ভোট হল। কোথাও বিজেপি পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। বিভিন্ন রাজ্যের উপনির্বাচনে বা স্থানীয় স্তরের নির্বাচনেও বিজেপির হারের খবর এসেছে বিভিন্ন রাজ্য থেকে।
তা হলে কি মোদীর জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তেমনও বলছেন না। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হিসেবে এখনও কেউ উঠে আসতে পারেননি। রাহুল গাঁধীকে মোদীর বিকল্প হিসেবে জনতা মেনে নেননি। আঞ্চলিক নেতাদের ঘোঁটকেও জনতা বিশ্বাস করতে পারেনি। তার ফলেই ২০১৯ সালে মোদী ফিরলেন আগের চেয়েও বেশি গরিষ্ঠতা নিয়ে, মনে করছেন পর্ষবেক্ষকরা।
কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যাঁদের জোটকে বিশ্বাস করতে পারেননি মানুষ, তাঁরা কিন্তু নিজের নিজের রাজ্যে বা দুর্গে এখনও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যেই বরং রাজ্য স্তরের বিজেপি নেতাদের চেয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলির প্রধানরা অনেক বেশি ওজনদার এবং শক্তিশালী। ফলে বিধানসভা নির্বাচনে বা উপনির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারে লালুপ্রসাদ, মহারাষ্ট্রে শরদ পওয়ার বা দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীবালদের কাছে ধাক্কা খেতে হচ্ছে বিজেপি-কে।
এখনই যদি লোকসভা নির্বাচন হয়, তা হলে খড়্গপুর সদর বা কালিয়াগঞ্জ হয়তো আবার বিজেপির পক্ষেই ভোট দেবে, মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু রাজ্যের বা স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে বিজেপি সেই ফলেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকছে।
পশ্চিমবঙ্গে ৩ বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে একটা তৃতীয় ‘ফ্যাক্টর’ও কাজ করেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির— ‘পিকে ফ্যাক্টর’। লোকসভা নির্বাচনে বড়সড় ধাক্কায় বিচলিত তৃণমূলনেত্রী তড়িঘড়ি পিকে-কে নিয়ে এসেছেন। দলকে ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর জন্য পিকের সাহায্য নিয়েছেন।
তৃণমূলের পুনরুত্থান ঘটানোর দায়িত্ব নিয়ে কী করেছেন পিকে? প্রথমেই একের পর এক জনসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে ব্লক নেতৃত্ব পর্যন্ত সব স্তরকে অনবরত রাস্তায় থাকতে বাধ্য করেছেন। হারের ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যাতে ঘরে ঢুকে না যান, তা নিশ্চিত করেছেন।
তৃণমূলের ভাবমূর্তি সংশোধনের চেষ্টাও গত কয়েক মাসে খুব মন দিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন পিকে। অনুব্রত মণ্ডল, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকদের মতো যে নেতারা নিরন্তর বিতর্কিত কথা বলা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন, মিডিয়ার সামনে তাঁদের মুখ খোলা প্রায় বন্ধ করিয়ে দিয়েছেন পিকে। যাঁর বিরুদ্ধে উদ্ধত ভঙ্গি বা আচরণের অভিযোগ উঠছিল, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আপাতত পিছনে রাখার বন্দোবস্ত করেছেন। গোটা উপনির্বাচন প্রক্রিয়ায় অভিষেকের মুখ প্রায় দেখাই যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চড়া মোদী বিরোধী সুরও অনেক নিয়ন্ত্রিত পিকে আসার পর থেকে।
টিম পিকে আরও একটা কাজ সফল ভাবে করেছে এই উপনির্বাচনে। এনআরসি নিয়ে বিজেপি বিরোধী প্রচার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু প্রায় নীরবে। তৃণমূল কর্মীদের মাধ্যমে এনআরসি বিরোধী বক্তব্য ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ছকও টিম পিকের-ই কষা বলে বিশ্লেষকদের মত। পিকের পরামর্শে একই সঙ্গে অর্থনীতির বেহাল দশা থেকে আগুন বাজারদর— সব কিছুর দায় বিজেপির উপরে চাপানোর চেষ্টাও তৃণমূল চালিয়ে গিয়েছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘প্রশান্ত কিশোর খুব পেশাদারিত্বের সঙ্গে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূল কর্মীদের। এনআরসি থেকে পেঁয়াজের দাম, বেহাল অর্থনীতি থেকে চাকরি না হওয়া, সবই বিজেপির দায়— ঘরে ঘরে পৌঁছে তৃণমূল কর্মীরা বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এ সব।’’
কিন্তু বিজেপি তার মোকাবিলা করতে পারল না কেন? ঘরে ঘরে গিয়ে বিজেপি কর্মীরাও তো তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে পারতেন? আত্মতুষ্টি এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই কাল হয়েছে— বলছেন দলের রাজ্য স্তরের প্রথম সারির মুখ সায়ন্তন বসু থেকে শুরু করে জেলা নেতা তথা তৃণমূল ভেঙে দিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরে বিজেপি-কে আড়ে-বহরে অনেকখানি বাড়িয়ে দেওয়া বিপ্লব মিত্র পর্যন্ত সকলেই। বিপ্লবের কথায়, ‘‘আমাদের দলের কর্মীদের ভোট ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অনভিজ্ঞতা ছিল। তৃণমূল যে একেবারে নীচের স্তরে প্রচারটাকে কোথায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল, কালিয়াগঞ্জে আমাদের কর্মীদের অনেকে তা বুঝতেই পারেননি। টাকা-পয়সার লেনদেন হয়েছে, সে খবরও পেয়েছিলাম। কিন্তু অনেকে সে খবরকে গুরুত্ব দিতে চাননি। ভেবেছিলেন কালিয়াগঞ্জে অনেক ভোটে এগিয়ে রয়েছি। ও সব করে তৃণমূলের লাভ হবে না।’’ সায়ন্তন বসুর দাবি, খড়্গপুরেও ঠিক একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
এতেও কিন্তু প্রশান্ত কিশোরের পরোক্ষ সাফল্যই দেখছে রাজনৈতিক শিবিরের একটা অংশ। একের পর এক ভিভিআইপি-কে হাজির করে চোখ ধাঁধানো প্রচার এ বারের উপনির্বাচনে এড়িয়ে গিয়েছে তৃণমূল। তাতে বিজেপি কিছুটা স্বস্তিতে থেকেছে। কিন্তু কর্মীদের কাজে লাগিয়ে একেবারে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দারুণ প্রচার চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা পিকে নীরবে করে দিয়েছিলেন বলে বিশ্লেষকদের মত।
পিকে সফল হননি, এ কথা কিন্তু উপনির্বাচনের পরে আর বলার জো নেই।