Police Firing

দুই শিক্ষকের কথায় প্রভাবিত হয়েই কি ঝাঁপিয়েছিল পুলিশ? নীরব এসপি

প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, তাপস বৃহস্পতিবার খণ্ডযুদ্ধের সময়ে রাস্তার উপর দাঁড়িয়েছিল। তখনই গুলিটা তার পেটের বাঁদিক ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বিপ্লব সরকার নামে আরও এক তরুণ। পায়ে গুলি লাগে তারও।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২১:৪৭
Share:

গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় রাজেশ সরকারের। —ফাইল চিত্র।

স্কুলের সামনে বিশাল খেলার মাঠ। তারপর কাঁচা রাস্তা। বড়জোর ১০-১৫ মিটার লম্বা রাস্তা। তারপরেই দোমোহনা-ইসলামপুর সড়ক। স্কুলের রাস্তাটা যেখানে পাকা সড়কের সঙ্গে মিশেছে, ঠিক তার উল্টোদিকেই স্কুলের মাঠের মুখোমুখি মধু সুইটস অ্যান্ড হোটেল। পুরনো দোকানটাই নতুন করে নির্মাণের কাজ চলছে।

Advertisement

শুক্রবার সকালে ওই দোকানের সামনেই দেখা গেল চাপ চাপ রক্ত। ঠিক ওই জায়গাতেই পড়ে ছিল ইসলামপুর কলেজের ছাত্র তাপস বর্মণের রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ দেহ। দোকানটা তাপসদেরই। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, তাপস বৃহস্পতিবার খণ্ডযুদ্ধের সময়ে রাস্তার উপর দাঁড়িয়েছিল। তখনই গুলিটা তার পেটের বাঁদিক ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বিপ্লব সরকার নামে আরও এক তরুণ। পায়ে গুলি লাগে তারও। সেখান থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে ইসলামপুরের দিকে রাস্তার উপর গুলিবিদ্ধ হয় আইটিআই ছাত্র রাজেশ সরকার।

দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাল। একজন এখনও চিকিৎসাধীন। ঘটনার পর কেটে গিয়েছে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময়। তারপরেও পরিষ্কার হল না কার গুলিতে প্রাণ গেল দুই পড়ুয়ার। প্রত্যক্ষদর্শী থেকে শুরু করে মৃত ছাত্রদের পরিবারের দাবি, পুলিশই গুলি চালিয়েছে। কিন্তু শুক্রবার বিকেলে জেলার পুলিশ সুপার সুমিত কুমার স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেন, পুলিশ গুলি চালায়নি। তাঁর দাবি, ছাত্রদের সঙ্গে মিশে ছিল প্রচুর বহিরাগত। সুমিত কুমার জানান, সেই বাইরের লোকের হাতে লাঠি ছাড়াও ছিল বোমা এবং বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র। তবে জেলা পুলিশ সুপার এটাও জোর দিয়ে বলতে পারেননি যে,ওই বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতেই মত্যু হয়েছে দুই তরুণের।

Advertisement

আরও পড়ুন: নিয়োগে ‘না’! তবু ওই দুই শিক্ষককে কেন ডাকল স্কুল? রহস্য বাড়ছে ইসলামপুরে

তবে তাঁর দাবির স্বপক্ষে জানান, পরিমল অধিকারী নামে এক পুলিশকর্মীর গুলি লেগেছে। এ ছাড়াও ১৪ জন পুলিশ কর্মী আহত হয়েছেন।পুলিশ সুপার বলেন, “বৃহস্পতিবার দুপুর দুটোর সময় পুলিশ জানতে পারে ওই দুই শিক্ষক স্কুলে চলে এসেছেন। তারপরেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।” ঠিক এখানেই পুলিশ সুপারকে প্রশ্ন করা হয়, ১৮ অগস্টও পুলিশ গিয়েছিল। তখন আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও, বৃহস্পতিবার এমনটা হল কেন?

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পুলিশ সুপার সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান। আর সেই জায়গাতেইএকটা প্রশ্ন উঠছে। তবে কি পুলিশকে আগেই একটা ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, স্কুলের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ?

শুক্রবার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা বলে, দুপুর দেড়টা নাগাদ পড়ুয়ারা স্কুলের গেটে তালা দিয়ে দেয়। ভিতরে অনেক ছাত্র বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল।প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ধীরে ধীরে জমা হতে থাকেন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র এবং কিছু অভিভাবকও।বৃহস্পতিবারই ছিল দাড়িভিটে হাটের দিন। দুপুরবেলা থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে হাটকে কেন্দ্র করে। সেই ভিড় থেকেও অনেকে কৌতূহলী হয়ে ভিড় জমায় স্কুলের সামনে।প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন বলেন,“সেই সময়েই পুলিশ ঢোকে বড়সড় বাহিনী নিয়ে। র‌্যাফও ছিল সেই দলে।” পুলিশ স্কুলে ঢোকার চেষ্টা করে। বাধা দেয় ছাত্রীরা। কারণ তারাই সামনে ছিল। ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ আগের দিন পুলিশকে বাধা দেওয়া হলেও পুলিশ জোর করে ঢোকার চেষ্টা করেনি। কিন্তু বৃহস্পতিবার পুলিশ গোড়া থেকেই ছিল মারমুখী। কিন্তু কেন?

এসপি স্বীকার না করলেও, পুলিশ সূত্রে খবর, স্কুলের এক শিক্ষক আসরাফুল হক খবর দিয়েছিলেন পুলিশকে। তিনি এবং সহকারি প্রধান শিক্ষক নুরুল হুদা বারবার ফোন করছিলেন। ইসলামপুর থানার এক আধিকারিক বলেন,“ওই দু’জন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, তাঁদের মারধর করবে ছাত্ররা। তাই আমরা জোর করে স্কুলে ঢোকার চেষ্টা করি।” সেখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে, তবে কি ওই দুই শিক্ষকের কথাতেই প্রভাবিত হয়ে পুলিশ পরিস্থিতি বিচার না করেই একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বলপ্রয়োগ করল?

তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজেরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা কেন করলেন না? এ সব প্রশ্নের জবাবেই জেলা পুলিশ সুপারের রুটিন জবাব,“আমরা তদন্ত করছি।”

আরও পড়ুন: ইসলামপুরে গুলিবিদ্ধ আরও এক ছাত্রের মৃত্যু, বন‌্ধ ঘিরে অশান্তি

এ সব কিছুর পরেও একটা প্রশ্নের জবাব মেলে না। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, পুলিশ লাঠি চার্জ করতেই স্কুলের সামনের জমায়েত ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়ে পাশের লোকালয়ে চলে যায়। শুরু হয় সেখান থেকে ইটবৃষ্টি। পাল্টা পুলিশ কাঁদানে গ্যাস এবং রবার বুলেট চালাতে শুরু করে। এক পুলিশ আধিকারিক বলেন,“তাঁরা বুঝতে পারেননি এতটা প্রতিরোধ হবে। তাঁরা জনতার মাঝে আটকে পড়েছিলেন।” জেলা পুলিশ সুপার সরাসরি বিজেপি বা রাস্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের যোগের কথা না বলেও বলেন,“যাদের আটক করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বিজেপি কর্মী রয়েছেন।”

ধরে নেওয়া গেল, গোটা ঘটনায় অন্য কোনও শক্তির মদত ছিল। আর সেখানেই প্রশ্ন, তবে পুলিশ পর্যাপ্ত খোঁজ খবর না নিয়ে ‘অল-আউট’ আক্রমণে গেল কেন? নিহত রাজেশের বোন মউ সরকার অভিযোগ করেন,“পুলিশ গাড়ি চেপে পালাচ্ছিল। জনতা তখন পেছন থেকে তাড়া করছিল। তখনই চলন্ত গাড়ি থেকে পুলিশ জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়।” তাপসের মা বলেন, “নীল-কালো জামা পরা, মুখে কালো কাপড় বাঁধা লোক গুলি চালিয়েছে।” তাপসের মায়ের বর্ণনার সঙ্গে র‌্যাফের পোশাকের মিল রয়েছে। আর এখানেই দাড়িভিটের মানুষের প্রশ্ন, রাস্তার একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে জনতা, সেই অবস্থায় জনতার মধ্যে থেকে যদি গুলি চলে তাহলে পুলিশের না লেগে জনতার মধ্যে দু’জনের লাগল কী করে? জেলা পুলিশ সুপারের জবাবে সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।

(মালদহ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং সহ উত্তরবঙ্গের খবর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা খবর পড়ুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement