চিকিত্সার জন্য নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অসুস্থ গৌরীদেবীকে। শিলিগুড়িতে বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের উপরে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত মহানন্দ মন্ডলের সঙ্গে থাকা এক মহিলা গৌরী মিত্র হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। সোমবার বিকেলে তিনি রামঘাট এলাকায় নিজের বাড়িতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে তাঁর স্বামী চিত্তরঞ্জনবাবু জানান। পরিবারের লোকজনদের অভিযোগ, শনিবার মন্ত্রী ওই এলাকায় মিছিল করেন। তার আগে গৌরীদেবীর বাড়িতে পুলিশ, কমব্যাট ফোর্স গিয়ে প্রশিক্ষিত কুকুর, বম্ব স্কোয়াড নিয়ে তল্লাশি চালায়। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। তারপর থেকেই গৌরীদেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে জানানো হয়েছে। মন্ত্রী ও তাঁর দলের লোকেদের বিরুদ্ধে রামঘাটের গণ্ডগোলের ঘটনায় এফআইআর-ও করেছিলেন গৌরী দেবী।
প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের অভিযোগ, মন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ এলাকার বাসিন্দাদের নানা ভাবে হুমকি দেওয়ায় এমনটা ঘটেছে। যদিও এ বিষয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তল্লাশির নামে হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকেও। এই ঘটনা সহ রামঘাট কাণ্ডের সমস্ত কথা জানিয়ে বুধবারই দার্জিলিংয়ে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হচ্ছেন জেলা কংগ্রেস নেতৃত্ব। বিজেপি-র তরফেও ঘটনাটি নিয়ে সব মহলে জানিয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোহ হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার বিকেল চারটা নাগাদ বাড়িতে একাই ছিলেন গৌরীদেবী। সেই সময়ই তিনি হঠাত্ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি পড়েও যান বলে জানান চিত্তরঞ্জনবাবু। পরে পাড়ার লোকজন দেখতে পেয়ে খবর দেন সকলকে। বাড়িতে প্রাথমিক চিকিত্সার ব্যবস্থা হলেও পরে তাঁকে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে রাতেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেবক রোডের একটি নার্সিংহোমে। সেখানে চিকিত্সকেরা পরীক্ষা করে তাঁর মস্তিকে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে বলে জানান বলে জানা গিয়েছে। চিত্তরঞ্জনবাবুর দাবি, “শনিবার পুলিশের একাধিকবার তল্লাশি ও হুমকির পর থেকেই আতঙ্কে ছিলেন গৌরীদেবী। দু’দিন ধরে রাতেও ঘুমোতে পারছিলেন না।” তাঁর সঙ্গে রাত থেকেই ছিলেন গৌরীদেবীর বোন মঞ্জু রায়। তিনি বলেন, “সন্ধ্যা পর্যন্ত কথা বলছিল। তার পর থেকে জ্ঞান নেই। স্যালাইন চলছে। কী হবে বুঝতে পারছি না।” মহানন্দবাবু, রাজেশবাবুরাও ছিলেন সারাদিনই। মহানন্দবাবু বলেন, “পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে হয়রানি করছে। এর কবে শেষ হবে তা বুঝতে পারছি না।”
এদিন সকালে তাঁকে নার্সিংহোমে দেখতে যান অশোকবাবু সহ সিপিএমের জেলা নেতারা। উদ্বেগ প্রকাশ করেন দার্জিলিং জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শঙ্কর মালাকারও। তাঁকে নার্সিংহোমে দেখতে যান রামঘাট কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া ও পরে জামিন পাওয়া কংগ্রেস নেতা রাজেশ যাদব, মহানন্দ মণ্ডলরাও। তাঁদেরও পুলিশ হয়রানি করছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা। যদিও হয়রানির অভিযোগ ঠিক নয় বলে মনে করছেন শিলিগুড়ি পুলিশের ডিসি (হেড কোয়ার্টার) অংমু গ্যামসো পাল। তিনি বলেন, “নিরাপত্তা যেন বিঘ্নিত না হয়, তা দেখতেই এলাকায় পুলিশ গিয়েছিল। ঘর বন্ধ করা বা তল্লাশির নামে হয়রানির অভিযোগ ঠিক নয়। কেউ অভিযোগ করতেই পারে। তবে তার ভিত্তি থাকতে হবে।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী বলেন, “অশোকবাবুদের কোনও রকম রাজনৈতিক বক্তব্যের উত্তর দেব না।” তাঁর কথায়, “তবে পুলিশের সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। তাই না জেনে পুলিশের কাজকর্ম নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।”
এই ঘটনার পর এদিন দুপুরে সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন অশোকবাবু। সিপিএমের দলীয় কার্যালয় অনিল বিশ্বাস ভবনে বৈঠকে তাঁর দাবি, “আমরা পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছি। প্রয়োজনে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করব। মন্ত্রীর নির্দেশেই এসব করছে পুলিশ।”
এদিন কংগ্রেস নেতা শঙ্করবাবু বলেন, “আমাদের দলের লোকেদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। রাজেশকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমার ফোন কল ট্যাপ করছে পুলিশ। এ নিয়ে মঙ্গলবারই শিলিগুড়ি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছি। আমরা সমস্ত কথা জানাতে ৭ জনের প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যপালের কাছে যাচ্ছি।” আজ, বুধবার বিকাল ৩টেয় রাজ্যপালের দেখা করার অনুমতি মিলেছে বলে শঙ্করবাবুর দাবি।
দার্জিলিং জেলার ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক অনিরুদ্ধ বসুও উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “পুলিশ যেভাবে অত্যাচার করছে তাতে আমরা শঙ্কিত। একজন যদি প্রাণ হারায়, আমরা ছেড়ে কথা বলব না। ফের রাস্তায় নামতে বাধ্য হব।”
গত ২৮ সেপ্টেম্বর শিলিগুড়ির জলপাই মোড় সংলগ্ন রামঘাট শ্মশানের বৈদ্যুতিন চুল্লির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে যান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতমবাবু। অনুষ্ঠান চলাকালীন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ আপত্তি জানায়। শ্মশানের গেটের সামনে তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। মন্ত্রী তাঁদের ভিতরে ডেকে নেন। তারপরেই দু’পক্ষের উত্তেজিত কথাবার্তার মাঝে মহানন্দবাবু আঙুল উঁচিয়ে ‘আমরাই এলাকার শেষ কথা’ বলে মন্ত্রীকে হুমকি দেন বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, ওই সময় মহানন্দবাবুকে মন্ত্রী চড়া মারেন। পরে তৃণমূল নেতা কৃষ্ণ পাল সহ অন্যরাও তাঁকে লাথি-ঘঁুষি ও গৌরীদেবীকে ধাক্কা দেন বলে অভিযোগ দায়ের করেন। মন্ত্রী ও অন্যদের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ দায়ের হয়। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর থেকেও অবশ্য একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ সরকারের অভিযোগের ভিত্তিতে মহানন্দ ও রাজেশকে গ্রেফতার করে। পরে তাঁরা জামিনে ছাড়া পান। বাম ও কংগ্রেসের অভিযোগ, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও তাঁকে বা কৃষ্ণবাবুকে জেরা পর্যন্ত করেনি পুলিশ। এই ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও গৌতম দেবের গ্রেফতারির দাবিতে শিলিগুড়িতে পথে নামে কংগ্রেস, বিজেপি ও বাম দলগুলি।