এসি যন্ত্রে বিভ্রাটের কারণে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার পরেও সেই হোটেলেই থেকে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে পুলিশ ওই হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করেছে।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বৃহস্পতিবারের ঘটনার পিছনে ‘গভীর ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তবে শুক্রবার ওই হোটেলের মালিক দিলীপ অগ্রবাল দাবি করেছেন, বাতানুকুল যন্ত্রে আগুন লাগার পিছনে যে তাঁর কোনও দোষ নেই সেটা মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন। সে জন্যই মুখ্যমন্ত্রী হোটেলও ছাড়েননি। দিলীপবাবু বলেন, “ঘটনার পরে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী লোক মারফত আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন, আমি যেন কোন টেনশন না করি সেটাও বলেছেন। তিনি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে গোটা বিষয়টি দেখেছেন।” এর পরে দিলীপবাবু জানান, ২০০৬ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর হোটেলে পাঁচ বার উঠেছেন। এ বারও ২০ এপ্রিল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী তাঁর হোটেলে থাকবেন বলে মালিকের দাবি। এই প্রসঙ্গে রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী বলেন, “মমতাদি হুট করে কাউকে অবিশ্বাস করেন না। মমতাদির ওই হোটেলের উপরে আস্থা আছে বলেই তিনি ওই ঘটনার পরেও অন্য হোটেলে যাননি। ওই হোটেলেই থাকছেন।”
তবে পুলিশ-প্রশাসন ও দমকল কিন্তু ঘটনার তদন্তে নেমে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার রাতেই হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মালদহ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন দমকলের ওসি। পুলিশ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করেছে। কিন্তু, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত গাফিলতিতে অভিযুক্ত কাউকে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। ওই ঘটনায় কেউ গ্রেফতারও হয়নি। দমকলের ইংরেজবাজারের ওসি সইদুল ইসলাম নারায়ণপুরের হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বাতানুকূল সরঞ্জাম দেখভালে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন। মালদহের পুলিশ সুপার রুপেশ কুমার বলেন, “দমকলের ওসি-র অভিযোগের ভিত্তিতে জামিন অযোগ্য ধারায় হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কী কারণে এসি মেশিনে আগুন লেগেছিল, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত জানার পরই হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেওয়া হবে।”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই হোটেলের ঘরে বাতানুকূল যন্ত্র ফেটে বিষাক্ত গ্যাসে মুখ্যমন্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সারা রাত অক্সিজেন ও স্যালাইন দেওয়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। অসুস্থ শরীর নিয়েই শুক্রবার মালদহ থেকে হেলিকপ্টারে বীরভূমের সিউড়ি, নলহাটি ও মুর্শিদাবাদে প্রচারে বেরিয়ে পড়েন। হেলিকপ্টারে ওঠার আগে মুখ্যমন্ত্রীর চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল। বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “আমার শরীরটা ভালো নেই। কাল রাতে যে গ্যাসটা নাকের ভিতরে ঢুকেছিল, তাতে সারা রাত খুব শ্বাসকষ্ট হয়েছে।”
ওই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গলা কাঁপছিল। খুব আস্তে আস্তে নিচু স্বরে হাঁপাতে হাঁপাতে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বাথরুমে ছিলাম। হঠাৎই খুব জোরে একটা শব্দ হল। বাইরে থেকে জয়দীপ চিৎকার করে উঠল। ভাগ্যিস, আমার বাথরুমের ছিটকিনিটা খোলা ছিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি গোটা ঘর অন্ধকার। গ্যাসে ভরে গিয়েছে। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। দমকলের লোকেরা বলল, ‘ম্যাডাম আপনি আর এক মিনিট ওই ঘরে থাকলে মারা যেতেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে গায়ে লেপ মুড়ি দিয়ে কোনওমতে বেরিয়ে আসি।”
ওই ঘটনার পরে চিকিৎসকেরা বিশ্রামের পরামর্শ দেন মুখ্যমন্ত্রীকে। সেই প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বললেই হল? সারা রাত অক্সিজেন, স্যালাইন নিয়েছি। কিন্তু এখন তো নির্বাচন। ঘরে কি থাকা যায়?” অন্য দিন হনহন করে হেলিকপ্টারে উঠতে দেখা গেলেও এদিন গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে হেলিকপ্টারে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর শোওয়ার ঘরের যে বাতানুকূল মেশিনে আগুন লেগেছিল তা পরীক্ষা করতে শুক্রবার দুপুরে কলকাতা থেকে ফরেনসিকের একটি বিশেষজ্ঞ মালদহে পৌঁছন। তাঁরা হোটেলের ঘরের সেই বাতানুকূল যন্ত্রটি পরীক্ষা করেন। ওই দলের প্রধান সি সরকার বলেন, “আমরা মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের এসি যন্ত্রের কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছি। আবারও করব। এখনও সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে বৈদ্যুতিন যন্ত্রে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে।”
এদিন আগুন লাগার জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুত বন্টন কোম্পানিও। সংস্থার মালদহের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার শৈবাল মজুমদার বলেন, “আমরা অনেকদিন থেকে ওই হোটেলের মালিককে বলছি ‘বাল্ক লাইন’ নিন। কিন্তু ওই হোটেল মালিক আমাদের কোন কথাই শোনেননি। হোটেলের দুর্বল ইলেকট্রিক সার্কিটের কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের এসি মেসিনের লাইন শট সার্কিট হয়ে আগুন লেগে গিয়েছিল। শুধু মুখ্যমন্ত্রীর ঘরেই নয়, গোটা হোটেলের ইলেকট্রিক লাইনেই সমস্যা রয়েছে।”
তবে দমকল ও বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থার অভিযোগ মানতে চাননি ওই হোটেলের মালিক দিলীপবাবু। তিনি বলেন, “৯ বছর ধরে ৬৩ কেভির ট্রান্সফর্মার আমার হোটেলে বিদ্যুত সরবরাহ করছে। কোন সমস্যা হচ্ছিল না। কাল দুপুর তিনটের সময় বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থা ৬৩ কেভির পরিবর্তে ১০০ কেভির ট্রান্সফর্মার বসানোর পরে এই বিপত্তি ঘটেছে। শৈবালবাবু অবশ্য বলেন, “ট্রান্সফর্মার পাল্টানোর সময়ে হোটেলের মালিক অনেক কথাই বলছিলেন। কিন্তু, উনি ইঞ্জিনিয়র নাকি! বিষয়টি আমরাই বুঝি। উনি অযথা কথা বললে তো হবে না।”