পাখির চোখে বাগডোগরা। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
পূব দিকটায় তির তির করে সারা বছর বয়ে চলে হুলিয়া নদী। দূরে হলেও নজরের আওতায় কার্শিয়াং। সকাল থেকে সন্ধে মাথার উপর দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে বিমানের ওড়াওড়ি। গভীর রাতে পানিঘাটার জঙ্গল থেকে এখনও ভেসে আসে দাঁতালের হুঙ্কার। পূর্ণিমার রাতে চা বাগান থেকে ভেসে আসা মাদলের বোল নেশা ধরায়।
শিলিগুড়ির কাছে এমনই মন কাড়া আয়োজন রয়েছে যেখানে, সেই জায়গার নাম যে বাগডোগরা তা সকলেরই জানা। এটাও প্রায় সকলেই জানেন, একটা সময়ে গণ্ডগ্রাম হলেও অবস্থানের গুরুত্বেই বাগডোগরা এখন গ্রামের তকমা ঝেড়ে ফেলে দস্তুর মতো শহর হয়ে উঠেছে। পাল্টে গিয়েছে এলাকার চেহারা। পূর্ব দিকে গোঁসাইপুর চেক পোস্ট থেকে যদি শহরের সূচনা ধরা যায় তাহলে পশ্চিম দিকে বিহার মোড় লাগোয়া এলাকাও এখন ঘিঞ্জি হয়ে গিয়েছে।
একটা সময়ে গোটা বাগডোগরা নিয়ে ছিল একটিই গ্রাম পঞ্চায়েত। জনসংখ্যার চাপ এতটাই বেড়ে যায়, ১৯৯৯ সালে তা ভেঙে বাগডোগরায় আপার ও লোয়ার দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন করতে হয়। এখন জনবসতির চাপ আরও বেড়েছে। পঞ্চায়তের হিসেব অনুযায়ী, বাগডোগরার মূল শহুরে এলাকা ও লাগোয়া বসতিতে লক্ষাধিক মানুষের বসবাস।
হু হু করে জনবসতি বাড়লে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ক্ষুদিরামপল্লি, কলেজপাড়া, অশোকনগর, লোকনাথ নগর, মসজিদপাড়া, এয়ারপোর্ট মোড় ঘন জনবসতিতে গড়ে উঠেছে। বিহার মোড় থেকে এয়ারপোর্ট মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অন্তত ৪ হাজার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ছোট দোকানিদের সংখ্যা ধরলে ৮ হাজার পেরিয়ে যাবে।
জনসংখ্যা বাড়লেও বাগডোগরার আয়তন বাড়েনি। কয়েকটি চা বাগান থাকলেও অর্থনীতি সেই ছোটখাট ব্যবসায়ীর উপরেই নির্ভরশীল। ‘ট্রেড সেন্টার হিসেবে বাগডোগরা বেশ সফলও। ফলে জনসমাগম বাড়ছে। ঠাসবুনোট হচ্ছে চারদিক। সেই তুলনায় পরিষেবার পরিকাঠামো বাড়ছে না। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সরিয়ে পুরসভা গঠনের প্রক্রিয়া বাম আমলেও গতি পায়নি। তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে সেই প্রক্রিয়া শুরু হলেও আচমকা গতি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে, পঞ্চায়েত পরিষেবা দিতে গিয়ে হাঁফিয়ে যাচ্ছে। যেমন বাগডোগরার বিবেকানন্দপল্লি এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য ভোলা গুহ বললেন, “বাগডোগরা এখন জমজমাট শহরের আকার নিয়েছে। পঞ্চায়েতের পক্ষে নাগরিক পরিষেবা দেওয়া কতটা সম্ভব? কষ্টেসৃষ্টে জঞ্জাল সাফাইয়ের পরিষেবা চালাতে হচ্ছে। তাও রোজ পরিষেবা দেওয়া যায় না। এভাবে হয় না। পুরসভা গড়তেই হবে। সেটা দলের তরফে নেতারা দেখছেন। প্রশাসনের শীর্ষকর্তারাও আশ্বাস দিয়েছেন।”
বস্তুত, আশ্বাস শুনতে শুনতেই বাগডোগরার বয়স বাড়লেও কাজের কাজ কিন্তু খুবই কম হচ্ছে। অন্তত, এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা তেমনই আক্ষেপ করেন। যেমন, শহরের ব্যবসায়ী সংগঠনের একাধিক কর্তা জানান, বাগডোগরার বুক চিরে চলে যাওয়া ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের দুধারে গড়ে ওটা দোকানপাটের ভবিষ্যৎ কী হবে তা আজও অজানা। তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রায় সকলেই শঙ্কায় থাকেন। কারণ, মাঝেমধ্যেই জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ মহাসড়ক গড়া হবে বলে ওই জমি খালি করার নোটিস ধরিয়ে দেয়। তা নিয়ে নানা মহলে ছোটাছুটি করে সেটা স্থগিত রাখার ব্যবস্থা করেন ব্যবসায়ীরা।
কিন্তু, এভাবে কতদিন চলবে? কেন রাস্তার দুধারের প্রায় ১৫০০ জন ব্যবসায়ীকে পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করবে না সরকার? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান না বাগডোগরার বাসিন্দারা। অথচ ইচ্ছে থাকলেই উপায় করা যায়। বাগডোগরায় জাতীয় সড়কের পাশেই রয়েছে রেলের অব্যহত বিশাল শেড। অন্তত ১০০ বিঘা জমি রয়েছে সেখানে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সেই জমি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াও হয়। পরে মুকুল রায় রেলমন্ত্রী হলে তা খানিকটা এগিয়েছিল। এখন সেই ফাইল ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে।
সেই ফাইল খুঁজে কাজের কাজটা করিয়ে নিতে পারবেন কে? এই প্রশ্নে চায়ের দোকান থেকে মন্দির, চার্চ, মসজিদ থেকে অয়প্পা মন্দিরের চাঁচাল, সর্বত্রই চলে নানা আলোচনা। কান পাতলেই একাধিক নেতা-কর্তাদের নাম করে বাগডোগরার বাসিন্দাদের অনেককেই আক্ষেপ করতে দেখা যায়। ওই আলোচনায় এটাও শোনা যায়, কংগ্রেস আমল থেকে বাম জমানা, হালের তৃণমূলের সময়েও বিমানে উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্তে যেতে বাগডোগরাই ভরসা মহাকরণ, নবান্নের নেতা-কর্তাদের। প্রায় সকলেই বাগডোগরার সমস্যার কথা জানেন। অনেকে হয়তো বাহডোগরা বাসীর ব্যাথার জায়গাটা উপলব্ধিও করেন। কিন্তু, যে জমি জটের ফাঁসে আটকে বাগডোগরার বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন না তার সমাধান কেন হবে না?
(চলবে)