এই সেই বাস।
উপযুক্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে রাজ্যে বেশ কয়েকবার বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রাণ গিয়েছে বেশ কয়েকজনের। তবু হুঁশ ফেরেনি। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের পাহাড়পুর মোড়ে একটি প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত কৌটো নিয়ে বোমাতঙ্ক দেখা দেয়। কিন্তু এত দমকল কর্মী উত্তম দাস খালি হাতেই কৌটোটি নিয়ে পাশের একটি ফাঁকা জমিতে নিয়ে গিয়ে রাখেন। যা দেখে অবাক বম্ব স্কোয়াডের তিন কর্মী। উত্তমবাবুর সাফাই, কৌটেটি দেখে মনে হয়েছিল তার মধ্যে বিস্ফোরক নেই।
কিন্তু এমনই ভেবে এর আগে ২০০৫ সালের জুলাইতে বারিকুল থানার ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত একটি বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান। ২০০৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জঙ্গলমহলে ছেনি হাতুড়ি দিয়ে কৌটো বোমা খুলতে চেষ্টা করে উত্পল ভক্ত নামে বম্ব স্কোয়াডেরই এক কর্মীর প্রাণ যায়। মারা যান জেলা পুলিশকর্মী বাসুদেব চক্রবর্তী। জখম হন পুলিশ, সাংবাদিক সহ ২৯ জন। আনন্দবাজার পত্রিকার চিত্র সাংবাদিক সৌমেশ্বর মণ্ডলের একটি চোখ বরাবরের মতো নষ্ট হয়ে যায়। সেই ঘটনা নিয়ে প্রবল হইচইয়ের পরেও হুঁশ ফেরেনি। ২০১৩ সালের ২৯ অগস্ট আলিপুরদুয়ার চৌপথীতে একটি বাজারের ব্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ। বম্ব স্কোয়াডের কর্মী লালবাহাদুর লোহার বম্ব স্যুট ছাড়াই এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে ব্যাগটি দেখতে যান। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণে মারা যান তিনি। সে বারেও চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছিল পুলিশ।
এ দিন সকালে টানা চার ঘণ্টা ধরে চলে রুদ্ধশ্বাস বোমাতঙ্ক। যদিও সিআইডি-র বম্ব ডিস্পোজাল স্কোয়াডের কর্মীরা বিস্ফোরণ ঘটাতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের কৌটা থেকে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এল নলেন গুড়ের সন্দেশের মতো ডালের গুঁড়োর তৈরি মণ্ড।
এদিন সকাল সওয়া ৮টা নাগাদ দু’জন যাত্রীকে নিয়ে বানারহাট-ধূপগুড়ি-বিন্নাগুড়ি গামী ডাবলু-বি ৬৩-৭১৮৮ নম্বরের বাসটি জলপাইগুড়ি ডিপো ছেড়ে যায়। ডিপো সূত্রে জানা গিয়েছে, কদমতলা থেকে চার পাঁচ জন যাত্রী বাসে ওঠেন। এর পরে বাসটি দাঁড়ায় স্টেশন মোড়ে। সেখানে জনা দুয়েক যাত্রী ওঠেন। বাসের কন্ডাক্টর নির্মল পাল জানান, সকাল ন’টা নাগাদ দিনবাজার ছেড়ে গেলে এক যাত্রী তাঁর ছেলেকে নিয়ে পিছনের ফাঁকা আসনে বসেন। কিছুক্ষণ না যেতে তিনি উঠে এসে জানান পিছনের বা-দিকের আসনের তলায় প্লাস্টিকের কৌটা পড়ে আছে। নির্মলবাবু বলেন, “ঘটনাটি শুনে বাসের পিছনে গিয়ে দেখি উল্টো করে পরে থাকা পলিথিন মোড়া প্লাস্টিকের কৌটা ভরা টুকরো জিনিস। সন্দেহ হয়। কোনও কথা না বলে চালককে বলি বাস ধীরে ধীরে রাস্তার পাশে দাঁড় করাতে। বাস দাঁড়ালে যাত্রীদের নামিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে বলি।” পাহাড়পুর মোড়ে জাতীয় সড়কের পাশে বাস দাঁড় করিয়ে কন্ডাক্টর প্রথমে জলপাইগুড়ি ডিপো কর্তা পরে পুলিশকে ফোনে ঘটনাটি জানান।
বাসটি জমিদারপাড়ার যেখানে দাঁড় করান হয়, সেখান থেকে চার কিলোমিটার দূরে বজরাপাড়ায় ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হন। ওই আতঙ্কে বাসিন্দারা বাসটি নিরাপদ দূরত্বে ফাঁকা জায়গায় সরানর দাবিতে সরব হলে পুলিশ কর্তারা বিপাকে পড়েন। ওই সময় চালক রামনাথ রায় আসনে বসে বাস পিছিয়ে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যান। বেলা ১২টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছয় দমকলের একটি ইঞ্জিন। পনেরো মিনিট পড়ে শিলিগুড়ি থেকে পৌঁছে যায় সিআইডি-র বম্ব ডিস্পোজাল স্কোয়াড। এর মধ্যে হাতুড়ি শাবল দিয়ে বাসের ইমারজেন্সি দরজা খোলার চেষ্টা শুরু হয়।
এদিকে পৌনে একটা নাগাদ দমকলের লিডিং অফিসার উত্তম দাস আচমকা বাসে উঠে বসেন। তিনি পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের কৌটাটি খালি হাতে তুলে নিয়ে রাস্তার পাশে ফাঁকা জমিতে নিয়ে রাখেন। ঘটনাটি দেখে অবাক তিন বম্ব স্কোয়াডের কর্মী সুবীর ঘোষ, কৈলাস রায় এবং সফিকুল ইসলাম। বেলা ১টা নাগাদ বম্ব স্কোয়াডের কর্মীরা নির্দিষ্ট পোশাক পড়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে কৌটো থেকে বেরিয়ে আসে নলেন গুড়ের সন্দেশের মতো ডালের গুঁড়োর তৈরি মণ্ড।
ছবি: সন্দীপ পাল।