অনুপ জায়সবাল
রাজার ভাত খাওয়ার এলাহি আয়োজন হয়েছিল।
শুধু পাতে পড়ার অপেক্ষায় ছিল মুরগি-মটন। হিট বাংলা-হিন্দি গান হালকা বাজছিল রাজাভাতখাওয়া বনবাংলোয়। তালে-তালে ছুঁচো ডন-বৈঠক দিচ্ছিল প্রজাদের পেটে। কিন্তু রাজা এলেন না।
রাজার সবে রাজত্ব বদল হয়েছে পুলিশ সুপারের কুর্সি ছেড়ে তিনি হতে যাচ্ছেন এনবিএফ-এর কমান্ডান্ট। প্রতি বারই ‘স্যর’ বদলি হলে থানাগুলো যে কায়দায় চাঁদা তুলে ‘ফেয়ারওয়েল’ দেওয়ার ব্যবস্থা করে, আলিপুরদুয়ারের প্রথম পুলিশ সুপার অনুপ জায়সবালের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি। নরম-গরম ঢালাও পানীয় আর আমিষ-নিরামিষ হরেক পদ। কমপক্ষে চারশো টাকা প্লেট। সাঁঝ গড়াতেই আসতে শুরু করেছিলেন জেলার আট থানার শ’খানেক খাকি উর্দি। কিন্তু রাত গড়ালেও ‘স্যর’ এলেন না। কারও তাই কুটোটিও দাঁতে কাটা হল না।
পরের দিন কালচিনি থানার সামনে বিলোনো শুরু হল ফিশ ফিঙ্গার, চিলি চিকেন, ভেজ পকোড়া, অনিয়ন পকোড়া, চিপস, নান, কুলচা, গ্রিন স্যালাড, রায়তা, সরু চালের ভাত, ফ্রায়েড রাইস, আলুর দম, মুগ ডাল, মটর পনির, রুইয়ের কালিয়া, কষা মাংস (পাঁঠা), রকমারি আচার, আইসক্রিম, তিন রকম মিষ্টি। শীতের রাতে বাঁচিয়ে রাখা গোটা মেনুটাই! অযাচিত মহাভোজ পেয়ে দু’হাত তুলে জয়ধ্বনি দিলেন গরিবগুরবোরা। আগের রাতে ফিশ ফ্রাইয়ের বদলে থানায় ফিরে শুকনো রুটি চিবোনো অফিসার-কনস্টেবলরা ম্লান হাসলেন।
কেন এই পরিহাস?
জেলা পুলিশের একাংশের দাবি, প্রথমে হাসিমারায় বিচ চা বাগানে সুপারকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু জেলাসদর আলিপুরদুয়ার থেকে ওই চা বাগানটি বেশ দূরে। অনুপবাবু জানিয়ে দেন, তাঁর পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। পরে রাজাভাতখাওয়ার বনবাংলোয় গত ১ ফেব্রুয়ারি ভোজসভার ব্যবস্থা করা হয়। সন্ধ্যে ৬টা থেকেই অফিসার ও কর্মীরা আসতে শুরু করেছিলেন। ইতিউতি নরম-গরম পানীয়, পকোড়া খাওয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু মূল খাবার জায়গায় সাজানো খাদ্য-পানীয়ে কেউ হাত দেননি। সাড়ে ৭টাতেও পুুলিশ সুপার বাংলো থেকে না বেরোনোয় দুই ইনস্পেক্টর তাঁকে ডাকতে যান। অনুপবাবু জানান, তিনি ব্যস্ত আছেন।
দুই ইনস্পেক্টর বনবাংলোয় ফেরার পরেই গুনগুনানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা করে-করে পুলিশকর্মীরা অধৈর্য হয়ে পড়তে শুরু করেন। রাত ৯টা নাগাদ পদস্থ কয়েক জন অফিসার সুপারের বাংলোয় গিয়ে অনুরোধ করেন, “স্যর, অন্তত দশ মিনিটের জন্য চলুন। এত আয়োজন হয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছে।” পুলিশের একাংশের অভিযোগ, উত্তরে সুপার রুক্ষ ভাবে বলেন, “জোর করে আমায় নিয়ে যাবে না কি?” তাতে অপমানিত বোধ করে অফিসারেরা বনবাংলোয় ফিরে আসেন।
এর পরেই সেখানে জোর তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। এক দলের মত ছিল, গত ছ’মাস দায়িত্বে থাকাকালীন সুপার তাঁদের যথেষ্ট জ্বালিয়েছেন। এখন যাওয়ার বেলাতেও ছাড়ছেন না। তাঁকে ফালতু গুরুত্ব না দিয়ে সকলের খেয়েদেয়ে চলে যাওয়া উচিত। আবার আর এক দলের মতে, এই অপমানের প্রতিবাদ হিসেবে খাওয়া বয়কট করা উচিত। শেষমেশ দ্বিতীয় মতটিই গ্রাহ্য হয়। সব খাবার বিলিয়ে দেওয়ার জন্য কালচিনি থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কেন বিদায় সংবর্ধনা নিতে এলেন না পুলিশ সুপার? পুলিশ মহলের অনুমান, ইতিমধ্যে অনুপবাবুর সঙ্গে বাকিদের যে তিক্ততা তৈরি হয়েছে, সেটাই এর মূল কারণ। দায়িত্ব নিয়েই অনুপবাবু আটটি থানার সাত অফিসারকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরেও কয়েক বার একাধিক অফিসার-কর্মীকে বদলি করেন। ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোর উপরে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও আলিপুরদুয়ার থেকে প্রচুর ট্রাক চোরাগোপ্তা অসমে চলে গিয়েছে বলে অভিযোগ পৌঁছয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের আইজি জাভেদ শামিমের দফতরে কয়লা পাচার সংক্রান্ত অভিযোগও জমা পড়েছে। এ সব নিয়ে জেলা পুলিশের একাংশের নানা নালিশ নবান্নেও পৌঁছে দিয়েছেন স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতা।
অনুপবাবুর দাবি, যে জেলার বয়স মোটে ছ’মাস, সেটিকে পুলিশ জেলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যা করার তার অনেকটাই তিনি করেছেন। কিন্তু তাঁর বদলির নির্দেশ আসার পরেই জেলার পুলিশ মহলে খুশির হাওয়া বয়ে যায়। অফিসারদের একাংশের অনুমান, সেই ‘উচ্ছ্বাস’ ফেয়ারওয়েল পার্টিতেও বেরিয়ে পড়তে পারে, এই আশঙ্কাতেই বিদায়ী পুলিশ সুপার তা এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পুলিশের শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এ যে মোটেই ভাল নজির নয়, গত চার-পাঁচ দিনে সেই আলোচনা কলকাতা পর্যন্ত গড়িয়েছে।
অনুপবাবুর অবশ্য দাবি, “শেষ দিন অবধি কাজের চাপ থাকায় যেতে পারিনি। এই ঘটনা নিয়ে কোনও অহেতুক জল্পনা করাটা ভুল হবে।”
তবে কে না জানে, জল্পনার হেতু থাক বা না থাক, তা কিছুটা জলেরই মতো। গড়াতে দিলেই গড়ায়।