পড়ে রয়েছে নিহত ছাত্রীর দেহ। রাজকুমার মোদকের তোলা ছবি।
ফের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ উঠল জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়িতে। রবিবার সকালে বাড়ির পাশের একটি সিমখেত থেকে উদ্ধার হয়েছে দশম শ্রেণির ওই ছাত্রীর দেহ। শনিবার সন্ধে থেকে সে নিখোঁজ ছিল। বেগুনি প্যান্ট এবং গোলাপি জ্যাকেট পরা কিশোরীর শরীরে নানা ক্ষত চিহ্ন মিলেছে। মুখ দিয়ে রক্তপাতও হয়েছে। তার পরিবার এ দিনই স্থানীয় কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্র অমিত রায়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছে। অমিতকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সেপ্টেম্বরেই এই শহরের অন্য একটি এলাকায় এক দশম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। তার পরে ফের শহরের অন্য এক এলাকায় আর এক ছাত্রীকে খুনের অভিযোগ ওঠায় সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত। এ ঘটনায় নিহত কিশোরী ও অভিযুক্ত, দু’জনেই এলাকার ভাল ছাত্রছাত্রী বলে পরিচিত।
অমিতের সঙ্গে ওই ছাত্রীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে কিশোরীর পরিবার দাবি করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ওই নাবালিকার স্কুলের খাতায় অমিতকে লেখা কিছু প্রেমপত্র উদ্ধার হয়েছে। গত ২৭ নভেম্বরের একটি চিঠিতে ‘আই মিস ইউ অমিত’ লেখা রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। ওই দিন অন্য একটি চিঠিতে নাবালিকা লিখেছে ‘সোনা আজ তোমার দিদির বিয়েতে তুমি এনজয় করছ। আমার খুব টেনশন হচ্ছে।’ তবে এই চিঠিগুলি ওই কিশোরী শেষ পর্যন্ত অমিতকে পাঠাতে পারেনি বলেই পুলিশের ধারণা। অমিতের কাছে ওই কিশোরীর তাকে লেখা কোনও চিঠি রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। অমিতও মেনে নিয়েছেন, ওই কিশোরীর সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে তাঁর সম্পর্ক ছিল। তবে তাঁর দাবি, কিছু দিন আগে নানা কারণে ঝগড়া হয়, তার পরে তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। অমিতের বক্তব্য, “আমার বিরুদ্ধে খুন ও ধর্ষণের ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হয়েছে।”
ছাত্রীটির বাবার অভিযোগ, “কিছু দিন আগে অমিত আমার মেয়েকে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দেয়। মেয়ে অস্বীকার করলে ছেলেটি হুমকি দেয় দেখে নেব বলে। বাড়িতে এসেও শাসিয়ে যায়।” তাঁর দাবি, “প্রতিশোধ নিতে অমিত মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করেছে।” যদিও অমিত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, “সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে ও আমাকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ওর ফোন না থাকায় যোগাযোগ রাখতে পারত না। ও অন্য ফোন থেকে যোগাযোগ করলে কথা হতো। গত এক সপ্তাহ ধরে কোনও কথা হয়নি। তবু আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।”
মেয়ের সঙ্গে অমিতের প্রেমের কথা অস্বীকার করেননি ওই কিশোরীর মা ও ভাই। নাবালিকার মা বলেন, “ওদের ভালবাসা ছিল। সেটা পরে কেন ভেঙেছে জানি না।” নাবালিকার দাদা জানায়, “বোনের মোবাইল নেই। অন্যের ফোনে অমিতের সঙ্গে কথা বলত।”
তবে এই ঘটনায় একাধিক দুষ্কৃতী জড়িয়ে থাকতে পারে বলেও সন্দেহ। বাড়ি থেকে বড় জোর দেড়শো মিটার দূরে ছাত্রীর দেহ উদ্ধার হয়েছে। বাড়ির পাশেই অন্য আত্মীয়দেরও বাড়ি রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন কেউ কিছু টের পেলেন না। স্থানীয় বাসিন্দাদের অবশ্য দাবি, নাবালিকার মুখে গামছা গুঁজে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়েছে। সে কারণেই চিৎকার শোনা যায়নি। শনিবার সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে ওই ছাত্রীর দেখা মেলেনি বলে পরিবারের দাবি। পাশেই এক আত্মীয়ের বাড়ি টিভি দেখতে গিয়েছিল সে। সেখান থেকে বেরোনোর পর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। রাত ন’টাতেও মেয়ে ফিরছে না দেখে মা-বাবা খোঁজ শুরু করেন। রাতভর ছাত্রীর খোঁজ মেলেনি। পেশায় কাঠ ব্যবসায়ী পরিবারের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছাত্রীটি মেজ।
পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন দুপুর নাগাদ জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে ছাত্রীর দেহ ময়নাতদন্তের পরে ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য দেহরসের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বিকেলে পুলিশ অমিতকে গ্রেফতার করে। জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল জানান, বেশ কিছু তথ্য ইতিমধ্যেই মিলেছে। তিনি বলেন, “অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে জেরা করা হচ্ছে। ওই ছাত্রীর স্কুলের খাতা থেকে কিছু প্রেমপত্র মিলেছে। পুরনো সম্পর্কের জের থেকে ওই ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। তবে তদন্তে অন্য দিকও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” এ দিন ঘটনাস্থলে যান ধূপগুড়ির বিধায়ক সিপিএমের মমতা রায়। তিনি বলেন, “সঠিক তদন্ত করে পুলিশ রহস্যের কিনারা করুক।”
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেই ধূপগুড়ির রেললাইনের পাশ থেকে দশম শ্রেণির আর এক ছাত্রীর বিবস্ত্র দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ছাত্রীকেও ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। আগের রাতে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের উপস্থিতিতে সালিশি সভায় তার বাবাকে মারধরের প্রতিবাদ করায় ছাত্রীটিকে সভাতেই ‘থুতু চাটানো’ সহ ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। হুমকির জেরে সালিশি সভা থেকেই ছাত্রীটি নিখোঁজ হয়ে যায় বলে তার পরিবারের দাবি। পরদিন তার দেহ মেলে। মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মী সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন ছাত্রীর বাবা। শাসক দলের নাম জড়িয়ে পড়ায় পুলিশের তদন্তেও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে।