রাজ্যের ৮০-রও বেশি পুরসভায় ভোট আগামী বছরে। তার মধ্যে রয়েছে উত্তরবঙ্গের একাধিক পুরসভাও। তার আগে, তিন দিনের সফরে উত্তরবঙ্গে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় কর্মীদের প্রতি বার্তা দেবেন বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তবে তাঁর সফরে রয়েছে সরকারি অনুষ্ঠানও। কোচবিহারে ছিটমহলের কাছাকাছি এলাকাতেও সভা করার কথা তাঁর। তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা।
আগামীকাল, মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ পৌঁছচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই দিন বেলা দু’টোয় শিলিগুড়িতে দলের কর্মিসভায় যোগ দেবেন তিনি। শহরের বাঘাযতীন পার্কে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার এই তিন জেলাকে নিয়ে কর্মিসভা হবে। তবে সেখানে না থাকলেও বাদ থাকছে না কোচবিহার। ৪ ডিসেম্বর দিনহাটার নয়ারহাটে সভা করবেন তিনি। তাই তিন দিনের সফরে কার্যত চার জেলার প্রতিই মুখ্যমন্ত্রী বার্তা দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার দুপুরের বিমানে বাগডোগরা পৌঁছনোর কথা মুখ্যমন্ত্রীর। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিমানবন্দর থেকে সোজা তিনি বাঘাযতীন পার্কের সভাস্থলে যাবেন। সভা করে সেখান থেকে যাবেন জলপাইগুড়িতে। তবে ওই দিন তাঁর আর কোনও কর্মসূচি নেই। কর্মীসভা উপলক্ষে আজ, সোমবার শিলিগুড়িতে পৌঁছনোর কথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের। রবিবার থেকেই কর্মিসভার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে জোর কদমে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ডিভাইডারগুলিতে তৃণমূলের পতাকা লাগানো হচ্ছে। সভা উপলক্ষে পুলিশের তরফে সমস্ত রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ঘটনাচক্রে, মুখ্যমন্ত্রীর সফরসূচির কাছাকাছি একাধিক জায়গাতেই আগামী বছরে পুরভোট রয়েছে। তার মধ্যে শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ি পুরসভা রয়েছে। শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়াদ ফুরিয়েছে গত ১ অক্টোবর। তার আগেই মেয়র ইস্তফা দেওয়ায় তিন সদস্যের প্রশাসক বোর্ড চালাচ্ছে। জলপাইগুড়ি পুরসভার মেয়াদ ফুরোচ্ছে ২০১৫-র মে মাসে। মালবাজার পুরসভার মেয়াদ এ বছর ইতিমধ্যেই ফুরিয়ে গিয়েছে। তেমনই কোচবিহারের কোচবিহার শহর, দিনহাটা, তুফানগঞ্জ ও মাথাভাঙা এই চারটি পুরসভাতেও আগামী বছরের গোড়ায় নির্বাচন হওয়ার কথা।
দলীয় কর্মীদের প্রতি কি বার্তা দেবেন মুখ্যমন্ত্রী? বিশদে বলতে চাইছেন না নেতারা। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব জানিয়েছেন, “কিছু সরকারি অনুষ্ঠান এবং দলীয় কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে আসছেন। শিলিগুড়িতে দলীয় কর্মী সম্মেলন হবে তিন জেলাকে নিয়ে। শিলিগুড়ি থেকে ওই তিনি তাঁর জলপাইগুড়িতে যাওয়ার কথা রয়েছে। বুধবার সেখানে স্পোর্টস ভিলেজের উদ্বোধন করবেন তিনি। এর বাইরে বিস্তারিত কর্মসূচি এখনই বলা সম্ভব নয়।” স্পোর্টস ভিলেজের মঞ্চ থেকে কয়েকটি নতুন প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করার সম্ভবনা রয়েছে বলে দলেরই একটি সূত্র জানিয়েছে।
জলপাগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর থাকার জন্য একাধিক জায়গা প্রস্তুত করা হয়েছে। দলের জলপাইগুড়ির জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী জানান, সে জায়গাগুলিতে মুখ্যমন্ত্রীর থাকার সম্ভবনা রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সেচ দফতরের বাংলো, পুলিশ ক্লাবের বাংলো। এ ছাড়া রামসাই রাইনো ক্যাম্প, ধূপঝোড়া বন বাংলো। জলপাইগুড়িতে একটি প্রশাসনিক বৈঠকও করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী।
৪ ডিসেম্বর কোচবিহারের দিনহাটায় সীমান্ত লাগোয়া নয়ারহাট গ্রামঞ্চায়েতের ডাকুয়াহাটে মুখ্যমন্ত্রীর সভার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ওই জায়গায় সভা কেন হচ্ছে তা নিয়েও রয়েছে জল্পনা। সভাস্থল থেকে বাংলাদেশী ছিটমহল করলা এক কিলোমিটার দূরে। এ ছাড়াও আশপাশে আরও কয়েকটি ছিটমহল রয়েছে। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের সংসদীয় কমিটিতে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিলের অনুমোদন হয়েছে। খুব দ্রুত ওই বিল রাজ্যসভায় পেশ করা হতে পারে। তা নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছেন ছিটমহলের বাসিন্দারাও। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ সীমান্তে ছিটমহল সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কী বলেন তা জানতে উত্সাহী বাসিন্দারা। বিরোধীরা অবশ্য দাবি করেছেন, ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতেই মুখ্যমন্ত্রী এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, আগাম কৃতিত্ব পকেটে পুরতে ছিটমহল থেকে এক কিলোমিটার দূরে জনসভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ছিটমহলবাসীদের পাশে রয়েছেন। প্রায় ষাট হাজার মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে রয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকে তাঁরা কোনও সুযোগ-সুবিধে পাচ্ছেন না। ওই সমস্যার হাত থেকে বের করে আনতেই উদ্যোগী হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাম আমলে ছিটমহল নিয়ে কোনও উদ্যোগ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী ওই সভা থেকে ছিটমহলের বাসিন্দাদের প্রতি বার্তা দেবেন।”
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পরই মাথাভাঙায় সভা করতে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিটমহল নিয়ে বলেছিলেন, এক ছটাক জমিও ছাড়া হবে না। তবে গত লোকসভা নির্বাচনের আগে দিনহাটায় তিনি আগের অবস্থান থেকে কার্যত সরে আসেন। সে বার তিনি বলেন, ওখানকার মানুষ যা চান তাই হবে। আমি জোর করে কিছু চাপিয়ে দিই না। এবারে ছিটমহলের পাশে গিয়ে সভা করে তিনি তাঁদের পাশে থাকার বার্তা দিতে চান বলে জেলা তৃণমূল সূত্রে খবর। জেলা স্তরের এক নেতার কথায়, “ছিটমহলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই সমাধান হতে চলেছে। সে কথাই তিনি বাসিন্দাদের জানাতে চান। ছিটমহলের বাসিন্দাদের সংখ্যা কম। কিন্তু তাঁদের পাশে রয়েছেন বহু মানুষ। সেই সব মানুষের সমর্থন নিজের দিকেই রাখতে চান মুখ্যমন্ত্রী।
রবিবার দিনহাটাতে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির ডাকে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত থেকে ছিটমহলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন রবীন্দ্রনাথবাবু। কমিটির পক্ষে থেকে দাবি করা হয়, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সভায় দশ হাজার লোক নিয়ে যাবেন। মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠিও দিতে চান তাঁরা। কমিটির সহকারি সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “ছিটমহল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে আমরা খুশি। তিনি যে শুধু মুখে কথা না বলে আন্তরিক ভাবে চাইছেন ছিটমহল সমস্যার সমাধান, তা এই সভার মাধ্যমে প্রমাণ করতেই তিনি আসছেন। তাঁর উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তাই তাঁকে কমিটির পক্ষ থেকে ছিটমহলের বাসিন্দারা ধন্যবাদ জানাতে চান।”
এ দিন রাজ্য পুলিশের আইজি জাভেদ শামিম, জেলাশাসক ডি উল্গানাথন, পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব-সহ দমকল, পূর্ত বিভাগের আধিকারিকরা নয়ারহাটের সভার জায়গা পরিদর্শন করেন। ছিলেন পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষও। সেখানে হেলিপ্যাড তৈরির কথাও হয়েছে। সেখান থেকেই বাগডোগরা হয়ে তাঁর কলকাতা ফেরার কথা।