সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর সন্ধ্যা-আরতির আগে সকলে বন্দেমাতরম গাইতেন। গান শেষ হলে তবেই শুরু হত মায়ের আরতি।
পুজো প্রাঙ্গণে বন্দেমাতরম কেন?
ভারত স্বাধীন হতে যে তেত্রিশ বছর বাকি। স্বাধীনতা আন্দোলন তাই ঠাঁই পেয়েছিল দুর্গাপুজোর মতো বড় সামাজিক আয়োজনেও। পুজো ঘিরে দার্জিলিঙের চাঁদমারি এলাকায় সচ্ছল সুশিক্ষিত বাঙালিরা একত্রিত হতেন। দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার জন্যই দেশবন্দনা করা হত। পাহাড়ি পথে ঘোড়ায় চড়ে সদস্যরা চাঁদা আদায় করতে বের হতেন। প্রতিমা নিয়ে আসা হত কলকাতার কুমারটুলি থেকে। শিলিগুড়ি থেকে টয় ট্রেনে চেপে প্রতিমা পৌঁছত মণ্ডপে। তখন লরি তো দূরের কথা, মোটরগাড়িই দার্জিলিং পাহাড়ে আসেনি। বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে আসতেন। পুজোর উপকরণ নিয়ে আসা হত কলকাতার নিউ মার্কেট থেকে। পদ্মফুলও। ঢাকি আসত নদিয়ার কুরুলগাছি থেকে। পুজোর খরচ হত ছ’শো থেকে হাজার টাকার মধ্যে। তার আগে দার্জিলিংবাসী দুর্গাপুজো বলতে জানত লুইস জুবলি স্যানিটোরিয়ামে বিজয়া দশমীর দিন খেলাধুলো, উৎসব, মিষ্টি বিতরণ।
স্থানীয় বাঙালিরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দেশে ১৯১৪-তে যে দুর্গাপুজো শুরু করেন, এ বছর সেই পুজো শতবর্ষে পৌঁছেছে। যা দার্জিলিংবাসীর কাছে শ্রীমন্দিরের পুজো নামেই পরিচিত।
মাস ছয়েক আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে একশো বছর উদযাপনের প্রস্তুতি। কলকাতা নয়, শিলিগুড়ির মহানন্দা পাড়া থেকে আসছে ডাকের সাজের প্রতিমা। বরাবর যে স্থায়ী মণ্ডপে পুজো হত, শতবর্ষ উপলক্ষে সেই শ্রীমন্দিরের ঠাকুরদালান ও মণ্ডপ আগাপাশতলা ফুল দিয়ে সাজানোর প্রস্তুতি চলছে। গাঁদা, রজনীগন্ধা আর গোলাপে মণ্ডপসজ্জায় হাত লাগাবেন শিলিগুড়ির শিল্পীরা। চন্দননগরের আলোকসজ্জায় শুধু পুজো প্রাঙ্গণই নয়, দার্জিলিঙের পাহাড়ি পথের বাঁকে দেখা যাবে আলোর রূপসজ্জা। এক সময় পুজোর তিন দিনই পাত পেড়ে ভোগ খাওয়ানো হত। থাকত বিকালে চা-জলখাবারের ব্যবস্থাও। বর্ধমানের মহারাজারা অষ্টমীর দিন মিষ্টান্ন ভোগ পাঠাতেন। শতবর্ষের হাত ধরে ফিরে আসবে সেই ঐতিহ্য। হাজার তিনেক লোকের পাত পেড়ে খাবার ব্যবস্থা থাকছে। মেনু খিচুড়ি, ফ্রায়েড রাইস।
পুজোর তিন দিন ধরে চলত থিয়েটার। সপ্তমীর দিনটি থাকছে কচিকাঁচা ও মহিলাদের জন্য। পুজো কমিটির সম্পাদক প্রতাপাদিত্য গুহ জানান, এ বছর মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যাবে শতবর্ষ পালনের নানা কর্মসূচি। পাঁচ দিন চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দশমীতে নিরঞ্জনের আগে প্রতিমা নিয়ে আসা হত রোজব্যাঙ্ক এলাকায় বর্ধমান রাজবাড়িতে। তখন রাজবাড়ির তরফ থেকে নিবেদন করা হত থালাভরা মিষ্টি। মায়ের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত সোনার গিনি। সেই প্রথা এখন আর নেই। তবে শতবর্ষের কথা মাথায় রেখে এ বারে বিসর্জনেও চমক। ট্রলিতে প্রতিমা উঠিয়ে তা জুড়ে দেওয়া হবে টয়ট্রেনের সঙ্গে। পাহাড়ি পথে ট্রেনে চেপে সেই প্রতিমা বিসর্জন হবে সোনাদার কাছে বাংলাখোলাতে। শোভাযাত্রায় শোনা যাবে সদস্যদের গান—‘এসো মা এসো মা এসো’।