বিকেল পাঁচটা নাগাদ, মোহনবাটি মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল সাদা রঙের স্করপিও গাড়িটা। করণদিঘি থেকে কালিয়াগঞ্জ ফেরার পথে বুধবার রায়গঞ্জের শিলিগুড়ি মোড় থেকে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয় মোহনবাটির দিকে। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হওয়ার পরেই চালককে মোহনবাটির মন্দিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন সত্যরঞ্জন দাশমুন্সি।
পুজো দেওয়ার পরে মন্দিরের চাতালে বসেই বেশ খানিকক্ষণ গল্পগুজব করলেন সত্যরঞ্জনবাবু। স্থানীয় ক্লাবের সদস্যদের ডেকে নিয়ে এলাকার সমস্যা নিয়েও আলোচনা করেন তিনি। ঘণ্টা দেড়েক পরে মন্দির থেকে বের হওয়ার সময় বললেন, “দাদার থেকেই রাজনীতি এবং উন্নয়ন শিখেছি। প্রতি ভোটে প্রার্থী ঘোষণার পরে দাদাকে দেখেছি এই মন্দিরে এসে পুজো দিয়ে প্রচার শুরু করতে। এটাও দাদাকে দেখেই শেখা।”
দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০০৮ থেকে ভর্তি সত্যরঞ্জনবাবুর দাদা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জনবাবু। রায়গঞ্জ েআসন থেকে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন সত্যরঞ্জনবাবু। কংগ্রেসের থেকে ওই আসনেই তাঁর ‘বৌদি’ তথা বিদায়ী কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী দীপাদেবীরও প্রার্থী হওয়ায় প্রায় নিশ্চিত বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর। সে কথাও বিলক্ষণ জানেন তিনি। তা হলেও, পরিবার ও রাজনীতি অন্তত দাশমুন্সি পরিবারের মিশে যাবে না বলেই তিনি দাবি করেছেন। সত্যরঞ্জনবাবুর কথায়, “আমি জানি আমার বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে বৌদি (দীপাদেবী) দাঁড়াচ্ছেন। বিরোধী প্রার্থী হলেও বৌদির সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্কের এতটুকুও অবনতি হবে না। আর রাজনৈতিক লড়াইয়ে বৌদিকে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দেব না।”
সত্যরঞ্জনবাবু যাই বলুন, তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করায় আপাতত রায়গঞ্জের লোকসভা ভোট প্রিয়বাবুর ‘পরিবার’ কেন্দ্রিক আবর্তিত হতে চলেছে। তৃণমূলের নেতারা মনে করছেন, ‘দাদা’-র আদর্শ, সান্নিধ্যের কথা প্রচারে বলে রায়গঞ্জের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রিয়বাবুর প্রতি সহানুভূতির হাওয়া দলের পালে টানতে পারবেন সত্যরঞ্জনবাবু। এ দিন তৃণমূলের প্রার্থী ঘোষণার পরেই দীপাদেবীর বক্তব্য, “তৃণমূল রাজনৈতিক স্বার্থে প্রিয়বাবুর পরিবারের পদবিকে কাজে লাগিয়ে রায়গঞ্জ কেন্দ্রে জয়ের স্বপ্ন দেখছে। আমি কোনও দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধেই কিছু বলতে চাই না। উন্নয়নের স্বার্থে মানুষের কাছে ভোট চাইব। তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ না করায় এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল তৈরির কাজ আটকে যাওয়া-সহ কেন্দ্রের উন্নয়ন প্রকল্পগুলি প্রচারে তুলে ধরা হবে।” ২০০৮ সালে প্রিয়বাবু অসুস্থ পড়ায় ২০০৯ সালে লোকসভায় দীপাদেবী রায়গঞ্জ কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হন।
এ দিন প্রার্থী ঘোষণা করেছে সিপিএমও। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমকে রায়গঞ্জে প্রার্থী করা হয়েছে। সিপিএমের একাংশের মতে, কংগ্রেস এবং তৃণমূলের দুই প্রার্থীই যথেষ্ট ওজনদার। সে কারণেই পাল্লা দেওয়ার জন্য সেলিমের মতো প্রাক্তন সাংসদকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে সিপিএম সূত্রের খবর। যদিও, দলের জেলা সম্পাদক বীরেশ্বর লাহিড়ি বলেন, “কোন দল কী বলল, কাকে প্রার্থী করল তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। জেলার বাসিন্দারা চেয়েছেন তাই মহম্মদ সেলিমকে রায়গঞ্জ কেন্দ্রের প্রার্থী করা হয়েছে। ডানপন্থী বিভিন্ন দল এর আগেও তো বহিরাগত প্রার্থীদের রায়গঞ্জে দাঁড় করিয়েছে।”
সত্যরঞ্জনবাবুকে প্রার্থী পেয়ে উৎসাহিত তৃণমূল শিবির। এ দিন দীপাদেবীর প্রতিক্রিয়ার উত্তর দিতে গিয়ে জেলা তৃণমূল সভাপতি অমল আচার্য বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই কেন্দ্রীয় সরকারকে পশ্চিমবঙ্গে চারটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের টাকা বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছেন। বাসিন্দারা সবই জানেন। সত্যরঞ্জনবাবুও উন্নয়নের সঙ্গে যথেষ্ট ভাবে যুক্ত।”
একসময়ে কংগ্রেস করলেও মাস দু’য়েক আগে তৃণমূলে যোগ দিয়ে রাজ্য রাজনীতিতেও প্রার্থী হওয়ার জল্পনা উস্কে দিয়েছিলেন সত্যরঞ্জনবাবু। বৃহস্পতিবার তিনি কলকাতায় যাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। তারপরেই আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচার শুরু করবেন তিনি। তবে তার আগে দিল্লির হাসপাতালে গিয়ে একবার দাদার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আসবেন বলে বুধবার জানালেন সত্যরঞ্জন দাশমুন্সি।