দূষণ রোখার কাজ থমকে দিয়েছে দুর্নীতি

সে হল বাম আমলের কথা। মহানন্দার দূষণ নিয়ে সমীক্ষায় মিলেছিল উদ্বেগজনক তথ্য-পরিসংখ্যান। সমীক্ষকরা দেখেছিলেন, শিলিগুড়ি শহরের যাবতীয় নালা-নর্দমার জলের অনেকটাই সরাসরি নদীতে পৌঁছয়। জোড়াপানি-ফুলেশ্বরীর মতো নদীগুলিতে সেই দূষণের হার আরও মারাত্মক। সরকারি সূত্র অনুযায়ী, ২০০২ সালে ওই নদীগুলির দূষণ কমানোর জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয়।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:১২
Share:

শিলিগুড়িতে মহানন্দা নদীতে দূষণ। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

সে হল বাম আমলের কথা।

Advertisement

মহানন্দার দূষণ নিয়ে সমীক্ষায় মিলেছিল উদ্বেগজনক তথ্য-পরিসংখ্যান। সমীক্ষকরা দেখেছিলেন, শিলিগুড়ি শহরের যাবতীয় নালা-নর্দমার জলের অনেকটাই সরাসরি নদীতে পৌঁছয়। জোড়াপানি-ফুলেশ্বরীর মতো নদীগুলিতে সেই দূষণের হার আরও মারাত্মক। সরকারি সূত্র অনুযায়ী, ২০০২ সালে ওই নদীগুলির দূষণ কমানোর জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। তাতে প্রস্তাব দেওয়া হয়, ৩টি নদীতে যথাক্রমে নিকাশি পরিশোধনের ব্যবস্থা হবে। সে জন্য ৩টি ‘স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ (এসটিপি) তৈরির প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে পেশ করে রাজ্য সরকার। রাজ্যের হয়ে ওই প্রস্তাব বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব পায় শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এসজেডিএ)। কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব খতিয়ে দেখে অনুমোদন দেয়। প্রাথমিক ভাবে এসজেডিএ প্রায় ৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়।

এসজেডিএ সূত্রের খবর, বরাদ্দ মেলার পরে এসটিপি তৈরির জমি, পাইপ বসানোর জায়গা মিলতে বছর গড়িয়ে যায়। ২০০৬ সালে দুটি এসটিপির জন্য প্রয়োজনীয় জমি মেলে। জোড়াপানি ও ফুলেশ্বরীর জল পরিশোধনের জন্য ডাবগ্রামে এসটিপি তৈরি হয়। এসজেডিএ সূত্রেই জানা গিয়েছে, এসটিপি করার লক্ষ্য ছিল, শহরের যাবতীয় জঞ্জাল মিশ্রিত জল কয়েক দফায় পরিস্রুত করা হবে। প্রথমে ডাবের কোলা, প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ, থার্মোকল জাতীয় আবর্জনা ছেঁকে ফেলা হবে। সেই জল দ্বিতীয় দফায় পরিস্রুত করে যতটা সম্ভব জীবাণু মুক্ত করা হবে। তৃতীয় দফায় পরিশোধনের পরে জল ফেলা হবে নদীতে। ফলে, নদীর দূষণও কমে যাবে। নদীখাত আবর্জনায় ভরে যাওয়াটাও কমবে।

Advertisement

ঘটনা গল, ২০০৯-২০১০ সালের মধ্যে দুটি এসটিপি-র সিংহভাগ কাজ হয়ে যায়। নির্মাণের সামান্য কাজ বাকি ছিল। পাম্প বসানোর কাজই শুধু হয়নি। রাজ্যে বাম জমানার অবসানের পরে সেই এসটিপি দুটি চালু করার ব্যাপারে তোড়জোর শুরু হয়। এসজেডিএ-এর অন্দরের খবর, ওই দুটি প্রকল্প চালুর কাজ হওয়ার আগেই তা পরিবর্ধনের জন্য প্রস্তাব তৈরি হয়ে যায়। সে জন্য এসজেডিএ-র নিজস্ব তহবিল থেকে টাকাও বরাদ্দ হয়। ঘটনাচক্রে, বছর দেড়েকের মধ্যেই এসজেডিএ-র অন্তত ৬০ কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগে তোলপাড় হয় রাজ্য। তৃণমূলের শিলিগুড়ির বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারিত হন। রাজ্য সরকার এসজেডিএ-র দুর্নীতি নিয়ে একাধিক মামলা দায়ের করে। সেই মামলার জেরে গ্রেফতার হন প্রাক্তন মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক তথা মালদহের তত্‌কালীন জেলাশাসক গোদালা কিরণ কুমার।

এসজেডিএ-র এসটিপি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একাধিক অফিসার-কর্মীর আক্ষেপ, দুর্নীতির একাধিক মামলার ধাক্কায় শিলিগুড়ির নদী দূষণের যাবতীয় আয়োজন জলে যেতে বসেছে। শুধু তা-ই নয়, বাম আমলে যতটা কাজ হয়েছে, তৃণমূল জমানায় তার তুলনায় মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানের কাজ কেন এগোয়নি সেই প্রশ্নেও এসজেডিএ-এর অন্দরে নানা বিতর্ক রয়েছে। নদী দূষণের কাজ না হলেও জোড়াপানি নদীর মাটি কাটায় কত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং কোন নেতা-কর্তা-ইঞ্জিনিয়র অভিযুক্ত তা নিয়ে এখনও চুলচেরা আলোচনা চলছে।

ফলে, শহরের নদী দূষণ রোখার কাজ শিকেয় উঠেছে বলে পরিবেশপ্রেমীদের অভিযোগ। যদিও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব, যিনি এখন এসজেডিএ-এর চেয়ারম্যান তিনি নানা সময়ে নদী দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হিমালয়্যান নেচার অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-সহ শহরের প্রথম সারির সব কটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন। বাস্তবে কাজের কাজ যে হয়নি তা মহানন্দা, ফুলেশ্বরী, জোড়াপাড়ির হাল থেকেই বোঝা যাচ্ছে। অথচ এসজেডিএ-এর নিজস্ব তহবিলে অন্তত ১৬০ কোটি টাকা ছিল। যেখান থেকে কয়েক কোটি টাকা খরচ করলেই দুটি এসটিপি চালু হতো। তাতে কেন্দ্র থেকে আরও বরাদ্দ চাওয়ার পরিস্থিত তৈরি হতো বলে ইঞ্জিনিয়রদের কয়েকজনের দাবি।

সে সব হয়নি। এসজেডিএ-এর টাকায় বহু কোটি টাকা খরচ করে শহরে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। একাধিক শ্মশান তৈরির নামে বহু কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। বহু কোটি টাকা খরচ করে ত্রিফলা আলো বসানো হয়েছে। যা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ৩ জন ইঞ্জিনিয়র, ৭ জন ঠিকাদারকে জেলে যেতে হয়েছে। এখন সিসি ক্যামেরা অধিকাংশই অকেজো। ত্রিফলা আলোও অনেক জায়গায় জ্বলে না। তাই শিলিগুড়ির নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এখন দাবি উঠেছে, দ্রুত এসজেডিএ-এর যাবতীয় দুর্নীতির মামলায় নয়ছয় হওয়া টাকা উদ্ধার করে শহরের নদী দূষণের তৈরি হওয়া এসটিপি চালু করা হোক। নাগরিক সমিতির মুখপাত্র দূর্গা সাহা বলেন, “আমরা শহরে ঘুরে সই সংগ্রহ করব। যা পরিস্থিতি দেখছি তাতে শহরবাসীদেরই রাস্তায় নেমে মহানন্দা সহ সব কটি নদীকে বাঁচচাতে জোট বাঁধতে হবে।”

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement