দূষণ থেকে বিপদ, শঙ্কা নিয়েই বসবাস

পরিবেশ বিধির তোয়াক্কা না করে কোথাও ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ গড়ে উঠলে লাগোয়া এলাকায় নানা ধরনের রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। পেটের রোগ, ফুসফুসে সংক্রমণ, চর্মরোগের আশঙ্কাই বেশি থাকে। অন্তত বিশেষজ্ঞরা তা-ই মনে করেন। নানা সময়ে সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা জানতে পেরেছেন, ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ৪০ ধরনের রোগ ছড়াতে পারে।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৫১
Share:

গবাদি পশু ঘুরে বেড়ায় অবাধে। খোলা আবর্জনায় উড়ে বেড়ায় পাখির ঝাঁক। রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকেই। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

পরিবেশ বিধির তোয়াক্কা না করে কোথাও ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ গড়ে উঠলে লাগোয়া এলাকায় নানা ধরনের রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। পেটের রোগ, ফুসফুসে সংক্রমণ, চর্মরোগের আশঙ্কাই বেশি থাকে। অন্তত বিশেষজ্ঞরা তা-ই মনে করেন।

Advertisement

নানা সময়ে সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা জানতে পেরেছেন, ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ৪০ ধরনের রোগ ছড়াতে পারে। যেমন, ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণে জন্ডিস, আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হতে পারে। খাবারে বিষক্রিয়ার আশঙ্কাও থাকে। কলেরা, আমাশা, ডায়েরিয়ার প্রকোপও ওই এলাকায় দেখা দিতে পারে। ফুসফুসের রোগ দেখা দিতে পারে। ওই এলাকায় কৃমির প্রকোপ বাড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা এটাও জানাচ্ছেন, দিনের পর দিন যদি একটা এলাকায় জঞ্জাল জমে-পচে-আধপোড়া অবস্থায় রাখা হয় তা থেকে বাসিন্দাদের আরও বিপজ্জনক রোগের আশঙ্কাও থেকে যায়।

ডাম্পিং গ্রাউন্ড লাগোয়া এলাকায় গেলে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শোনা যায় বেদনাদায়ক নানা অভিজ্ঞতার কথা। একতলা থেকে ৫ তলা, সব বসবাসকারীর অভিজ্ঞতাই একই রকম। সকলেই যে কোনও মুহূর্তে রোগের সংক্রমণ হতে পারে এটা মাথায় রেখে পা ফেলেন। ইস্টার্ন বাইপাসের ওই ডাম্পিং গ্রাউন্ড লাগোয়া এলাকা বৈকুণ্ঠপল্লি, জ্যোতিনগর ও লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছেন। সকলেই উদ্বিগ্ন থাকেন শিশুদের নিয়ে। কারণ, শিশুদের মধ্যে রোগের প্রকোপ বেশি হওয়ার আশঙ্কা। ছোটবেলা থেকেই কোনও শিশু মাথা ধরার জন্য ঠিক মতো পড়াশোনা করতে পারছে না। কেউ খাবার খেতে গেলেই বমি করে ফেলছে। সারা বছর পেটের রোগ, চর্মরোগে ভুগছে এমন খুদেদের সংখ্যাও কম নয়।

Advertisement

ডাম্পিং গ্রাউন্ডের কাছেপিঠের বাসিন্দারা যে এমন বিপদ মাথায় নিয়ে বসবাস করেন তা শিলিগুড়ির শহরের আর পাঁচটা এলাকার সকলেই কমবেশি জানেন। হয়তো অনেকের ধারণা, ডাম্পিং গ্রাউন্ডের আশেপাশে যা হচ্ছে হোক, আমাদের এলাকায় তো আর আবর্জনা জমা হচ্ছে না। অনেকে যুক্তি সাজাতে পারেন, যখন ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ওই জায়গায় ব্যবহার হচ্ছিল, তখন জেনেবুঝেই তো ওই বাসিন্দারা সেখানে বাস করতে গিয়েছিলেন। তা হলে এখন কেন য ঝুঁকি, রোগভোগের কথা বলা হচ্ছে সেই প্রশ্নও অনেকে তুলতে পারেন।

এই ব্যাপারে অবশ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ভিন্নমত। যেমন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞ শেখর চক্রবর্তী বলেন, “ডাম্পিং গ্রাউন্ডের আবর্জনা তো খোলা জায়গায় জমা হয়। সেখানকার মশা-মাছি কি শুধু সেখানেই উড়বে নাকি! কাক-শকুন-চিল-বকও তো ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে উড়ে গোটা শহরেই যাচ্ছে। সেখানকার জল তো গিয়ে নদী-নালায় পড়ে মূল শহরে ঢুকছে। যে জলাধার থেকে পানীয় জল সরবরাহ হচ্ছে সেখানেও কোনওভাবে ডাম্পিং গ্রাউন্ড ছুঁয়ে যাওয়া জল মিশতে পারে। কাজেই বিপদটা গোটা শিলিগুড়ির মাথার উপরেই রয়েছে।”

শুধু তাই নয়, বাতাস বাহিত জীবাণু ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে পাশের স্কুলে, বাড়িতে, গোটা শহরেই যে ছড়াচ্ছে না সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে? এমন প্রশ্নও তুলে উদ্বিগ্ন শেখরবাবু বলেন, “একটা শহর বাড়ছে। জঞ্জাল বাড়ছে। তা হলে দূষণও বাড়বে। নানা রোগের আশঙ্কাও বাড়বে। এটা মাথা রেখে নাগরিকদের নিরাপদ জীবনযাপন নিশ্চিত করতেই বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে ডাম্পিং গ্রাউন্ড তৈরি করতে হবে।”

বস্তুত, পুর কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ দফতর, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি তো বটেই, সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্তারাও ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে ভয়াবহ দূষণ, রোগ ছড়ানোর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তা সে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য কিংবা বর্তমান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব, সকলেই ডাম্পিং গ্রাউন্ডটি অন্যত্র সরানোর কথা ভাবেন। কিন্তু, যেখানে সরাবেন সেখানকার বাসিন্দাদেরও আপত্তি রয়েছে। ফলে, ডাম্পিং গ্রাউন্ডেই জঞ্জাল থেকে সার কিংবা বিদ্যুৎ তৈরির মতো কোনও প্রকল্প করার কথাও একাধিকবার ভেবেছে পুরসভা ও প্রশাসন। কাজও হয়তো কিছুটা এগিয়েছিল। কিন্তু, এক পা এগোনোর পরে নানা জায়গা থেকে হোঁচট খেয়ে দু-পা পিছিয়ে যেতে হয়েছে পুরসভা-প্রশাসনকে। প্রাক্তন মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত জার্মানি গিয়ে কী ভাবে সুষ্ঠুভাবে জঞ্জাল অপসারণ এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায় তা দেখে এলেও কাজ এগোয়নি। বিরোধী রাজনীতিকদের অনেকেই কটাক্ষ করেন, ‘জার্মানি ঘোরার ধকল ও খরচটা বৃথা হল।’

তৃণমূলের বাধায় প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য ডাম্পিং গ্রাউন্ড পুঁটিমারিতে সরাতে চেষ্টা করেও পারেননি। তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে গৌতমবাবুর পক্ষে পুঁটিমারিতে ডাম্পিং গ্রাউন্ড নিয়ে যাওয়াটা বাস্তবে কষ্টসাধ্য। অতীতে বাম আমলের কোনও মেয়রও জঞ্জাল অপসারণের ঠিকঠাক ব্যবস্থা করাতে ব্যর্থ হয়েছেন। কংগ্রেসের মেয়র গঙ্গোত্রীদেবীও কাজে ব্যর্থ হন বলে অভিযোগ। এখন পুরবোর্ড প্রশাসকের হাতে। আগামী দিনে ফের যে দল ক্ষমতাসীন হবে তারাও কতটা সদিচ্ছা দেখাবে তা নিয়ে শহরবাসীর মধ্যেই সংশয় রয়েছে।

তা হলে দূষণ-বিপদ বাড়বেই? না তা ঠেকানোর কোনও উপায় খুঁজছেন বিপন্ন শহরবাসী?

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement