রাজ্যের দ্বিতীয় দফার ভোটে আজ, বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলার চারটি কেন্দ্রে নির্বাচন। এই নির্বাচন কংগ্রেসের দুর্গরক্ষার লড়াই। উত্তরবঙ্গের চারটি কেন্দ্রের মধ্যে মালদহ উত্তর ও দক্ষিণ কেন্দ্র এবং উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ কেন্দ্রটি কংগ্রেসের দখলে। তিন কেন্দ্রেই এ বার চতুর্মুখী লড়াইয়ের মুখে কংগ্রেস। এই পরিস্থিতিতে ভোটের মুখে বিশেষ করে মালদহে সন্ত্রাসের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কংগ্রেস ও বাম দলগুলি। প্রশাসন অবশ্য সব ক্ষেত্রেই নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে।
পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে কালিয়াচকের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। লোকসভা ভোটে ওই সব এলাকায় পোলিং এজেন্ট দেওয়া যাবে কি না, সেই প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের কাছে আশঙ্কা জানিয়েছে মালদহ জেলা কংগ্রেস। একই রকম উদ্বিগ্ন মালদহ জেলা সিপিএমও। কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরী অভিযোগ কালিয়াচকের মোজামপুর, নওদা যদুপুর, জালুয়াবাঁধাল, নারায়ণপুরের মতো এলাকায় পঞ্চায়েতে প্রার্থী দেওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, “ওই এলাকায় এ বার লোকসভা ভোটেও সন্ত্রাস চালানো হবে বলে আশঙ্কা করছি। ২০টির বেশি পোলিং বুথে এজেন্ট দেওয়া মুশকিল হবে বলে মনে হচ্ছে। সে জন্য কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি।” সিপিএমের মালদহ জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্রও অবাধে ভোট হবে কি না, সেই প্রশ্নে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন কমিশনের কাছে। তিনি বলেন, “গত পঞ্চায়েত নিবার্চনে কালিয়াচকের ৪৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ৫টি পঞ্চায়েত সমিতিতে কংগ্রেস কিংবা সিপিএম প্রার্থী দিতে পারেনি। ওই এলাকায় বুথে এজেন্ট দিতে পারব কি না, জানি না।”
কংগ্রেস, সিপিএম কালিয়াচকে সন্ত্রাসের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন জেলা তৃণমূল সভানেত্রী সাবিত্রী মিত্র। তিনি বলেন, “কালিয়াচক থেকে কংগ্রেস ও সিপিএমের পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। সুজাপুর বিধানসভা ক্ষেত্রে প্রতিটি বুথে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন থাকছে। আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে কী করে ছাপ্পা ভোট সম্ভব?” এর পরে সাবিত্রী দেবীর দাবি, “মোজামপুর, নওদা যদুপুর, নারায়ণপুরে এখন কংগ্রেস, সিপিএমের কিছু নেই বলে ভয় পেয়েছেন ওঁরা।” তৃণমূল নেতা তথা মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীও দাবি করেছেন, সন্ত্রাসের গল্প ছড়িয়ে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা হচ্ছে।
মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে সুজাপুর বিধানসভা কেন্দ্রের সব ক’টি বুথই অতি স্পর্শকাতর। এই ২১২টি বুথের প্রত্যেকটিতেই আধা সামরিক বাহিনী থাকবে। এই সুজাপুরের মধ্যেই পড়ে কালিয়াচক।
ভোটের দিন তাঁর উপর হামলা হতে পারে এই আশঙ্কাও করছেন দক্ষিণ মালদহের কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরী অতিরিক্ত নিরাপত্তা চেয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, “গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় কালিয়াচকের নওদা যদুপুরের তৃণমূল আশ্রিত গুন্ডারা আমার উপর হামলা করেছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। এ বার আমি কালিয়াচকের সমাজবিরোধীদের জন্য সরব হয়েছি। সেই কারণে আমি আশঙ্কা করছি তৃণমূল আশ্রিত গুন্ডারা আমার উপর ফের হামলা করতে পারে।” মন্ত্রী সাবিত্রীদেবী বলেন, “কালিয়াচকসহ গোটা মালদহ জেলায় কংগ্রেস ভেঙে যে ভাবে দলে দলে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন তাতে ডালুবাবুরা আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছেন। সেই আতঙ্কেই মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে তৃণমূলের হামলার গল্প বানাচ্ছেন।” সাবিত্রী দেবীর অভিযোগ, “কংগ্রেস জেলায় গুন্ডাগিরির রাজনীতি অতীতে করেছে ও এখনও করছে।”
কালিয়াচকের সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য অবশ্য নতুন কিছু নয়। অন্তত পুলিশের নথি সে কথাই বলছে। খুন, জখম, অপহরণ, বোমাবাজি, গুলির লড়াইয়ের ঘটনা মাঝে মধ্যেই সেখানে ঘটে যায়। একটা সময়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে এলাকায় ভোটের সময়ে দাপট দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। কখনও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছে। এলাকার বাসিন্দারা অবশ্য চান, শান্তিতে ভোট হোক। কয়েকজন বাসিন্দা আক্ষেপ করেন, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে এলাকার দুষ্কৃতীদের একাংশ সেই দলে ভিড়ে যাওয়ায় কালিয়াচকে গোলমাল থামে না।
দক্ষিণ দিনাজপুরের কয়েকটি এলাকাতেও ভোট পর্ব নির্বিঘ্নে মেটানোর জন্য আর্জি জানানো হয়েছে বামেদের তরফে। সিপিএমের অভিযোগ, গঙ্গারামপুর এলাকার বেশ কিছু এলাকায় শাসক দলের তরফে হুমকি ও ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। গঙ্গারামপুরের ওই সমস্ত এলাকায় পরিদর্শনে যান জেলাশাসক। পরে জেলাশাসক জানান, অভিযোগের সারবত্তা মেলেনি।
যদিও বালুরঘাটের বিজেপি প্রার্থী বিশ্বপ্রিয় রায়চৌধুরীর আশঙ্কা কমেনি। তাঁর অভিযোগ, “অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করানোর জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বুথে মোতায়েন করা হয়নি। জেলায় নির্বাচনের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। সে জন্য রাজ্য নির্বাচন আধিকারিক এবং জেলা নির্বাচন আধিকারিককে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে।”
আশঙ্কা রয়েছে উত্তর দিনাজপুরেও। উত্তর দিনাজপুরের জেলা বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদক বীরেশ্বর লাহিড়ীর আশঙ্কা, “সন্ত্রাস যাতে না হয় সেটা নিশ্চয়ই পুলিশ-প্রশাসন দেখবে।” জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক পবিত্র চন্দ অবশ্য বলেন, “আমরা নির্বাচনে কোনও সন্ত্রাসের আশঙ্কা করছি না।” তবে ইসলামপুর ও রায়গঞ্জ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিজেপির জেলা সভাপতি শুভ্র রায়চৌধুরী। তিনি বলেন, “ইসলামপুর মহকুমায় সিপিএম ও তৃণমূল এবং রায়গঞ্জ মহকুমায় কংগ্রেস সন্ত্রাস করতে পারে বলে অভিযোগ পেয়েছি। আশা করি, পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী সতর্ক থাকবে।”
জেলা তৃণমূল সভাপতি অমল আচার্য সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দেন। তাঁর দাবি, “তৃণমূল নির্বাচনে ভাল ফল করবে তা বুঝতে পেরেই বিরোধীরা আগে থেকেই সন্ত্রাসের গল্প ছড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও জেলা প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। আশা করি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে।”