জলপাইগুড়ির চিঠি

আয়তনের নিরিখে রাজ্যের ষষ্ঠতম। বয়সের হিসেবে উত্তরবঙ্গের প্রাচীনতম শহর হল জলপাইগুড়ি। ১৮৮৫ সালে শহর পুরসভার মর্যাদা পায়। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য শহরের ঢের আগে। তবু কতটা সাবালক হতে পেরেছি আমরা? শহর হলেও, শতক পেরিয়ে জলপাইগুড়ির শহরায়ন কতটা হল?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:২৩
Share:

এমনই অবস্থা জলপাইগুড়ির করলা নদীর। ছবি: সন্দীপ পাল।

নিত্য যানজট থেকে নদীর দূষণ, কতটা সাবালক হল জলপাইগুড়ি?

Advertisement

আয়তনের নিরিখে রাজ্যের ষষ্ঠতম। বয়সের হিসেবে উত্তরবঙ্গের প্রাচীনতম শহর হল জলপাইগুড়ি। ১৮৮৫ সালে শহর পুরসভার মর্যাদা পায়। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য শহরের ঢের আগে। তবু কতটা সাবালক হতে পেরেছি আমরা? শহর হলেও, শতক পেরিয়ে জলপাইগুড়ির শহরায়ন কতটা হল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসলেই শহরের নিকাশি থেকে পরিবেশ, যানজট থেকে স্বাস্থ্য-- নানা সমস্যার কথা ভিড় করে আসে। তার মধ্যে যে সমস্যাটি সবচেয়ে ভাবিয়ে তোলে, তা হল করলা নদীর দূষণ। শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া যে নদীকে জলপাইগুড়ির ‘টেমস’ বলা হয়, তা আজ যেন বিষপাত্র হয়ে উঠেছে। মাঝে মধ্যেই করলা নদী সংস্কারের গালভরা প্রতিশ্রুতি শোনা যায়। কিছু পদক্ষেপও দেখা গিয়েছে। তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই। এককালের স্রোতস্বিনী করলা নদী প্রশাসনের ভাওঁতাবাজিতে আজ ভারাক্রান্ত। শহরের নানা প্রান্তের আবর্জনা নদীতে ফেলা হয়। তবে আশার কথা, এখনও সেটি ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ হয়ে ওঠেনি।

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, শহরের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে আনুমানিক ২,০২৬ জন বসবাস করেন। জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে শহরে। অন্যতম সমস্য যানজট। বিশেষ করে রেলগুমটি সংলগ্ন এলাকায় যানজট দিন দিন যেন বেড়েই চলছে। একাধিকবার শহরে উড়ালপুলের দাবি উঠলেও প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কোনও পদক্ষেপ করা যায়নি। ট্রাফিক ব্যবস্থাও যথেষ্ট ঢিলেঢালা। পুরসভার তরফে বেশ কয়েকবার জবরদখলকারীদের হাত থেকে ফুটপাত, রাস্তা মুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি।

Advertisement

শহরের নিকাশি ব্যবস্থা এখনও অতীতের হালেই রয়ে গিয়েছে। নিকাশির হাল ফেরাতে পরিকল্পনা হলেও, পুর প্রশাসন সেই অর্থে সফল নয়। অবশ্য শহরে জলমগ্নতা রোধে বেশ কয়েকটি ক্যানেল সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে পুরসভা এবং সেচ দফতরের যৌথ উদ্যোগে এখন শহরের বেশ কিছু অংশে বষায় জল দাঁড়ালেও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এটা অবশ্যই ভাল দিক। কিন্তু এখনও শহরের বেশিরভাগ নর্দমাই পাকা নয়, পাকা নর্দমার একটি বড় অংশে জল দাঁড়িয়ে থেকে মশার আঁতুর ঘরে পরিণত হয়েছে। ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’এর সমস্যা দীর্ঘদিনের। সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট চালু হওয়ার প্রাক এক দশক হতে চললেও, শহরে এখনও ‘আদর্শ ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ গড়ে ওঠেনি। প্রতিদিনের বর্জ্য একটি বিতর্কিত ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ডে’ ফেলা হচ্ছে। শহরবাসী জানে না কবে এই গ্রাউন্ডেরও মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। ‘সলিড ওয়েস্ট’ কতটা ম্যানেজ হচ্ছে সেটা ভবিষ্যতই বলবে। পুরসভার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, শহরের সব বাজারেই প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের রমরমিয়ে ব্যবহার চলছে। থার্মোকল সহ অন্যান্য বহু অপচনশীল বস্তুর ব্যবহার যত্রতত্র জলনিকাশি ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে তুলছে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, নজরদারি তথৈবচ।

এককালের ‘ক্লোরোফিল’ শহর জলপাইগুড়ি আজ সবুজ থেকে অনেকাই দূরে। শহরের কোনও রাস্তায় ৮০-১০০ বছরের শিরিষ গাছ জীবনের শেষ লড়াই লড়ে যাচ্ছে। শহরের গুটিকয়েক মাঠ ছাড়া ‘ঘাস’ পাওয়া দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুতল আবাসনের নামে শহর ও শহরতলীর বহু মাঠ এবং জলাশয় প্রতিনিয়তই অবৈজ্ঞানিক ও অবৈধভাবে বোজানো হচ্ছে। প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মী ও আধিকারিকদের মদত ছাড়া তা সম্ভব নয় বলেই মনে করি। দু’একটি ক্ষেত্র ছাড়া প্রতিবাদী মানুষের বড়ই অভাব। সরকারি উদাসীনতাও এই প্রবণতা বেড়ে চলার অন্যতম কারণ। উপযুক্ত তদারকির বড়ই অভাব। চারিদিকে ছেয়ে যাচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গল।

পরিবেশের সঙ্গে ছড়াচ্ছে সামাজিক দূষণও। দেশের অন্যান্য শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শান্তিপ্রিয় এই শহরেও ক্রমশ বেড়ে চলেছে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ড। বিভিন্ন নেশাদ্রব্যের আমদানি ও সহজলভ্যতা শহরের উঠতি বয়সের যুবক যুবতীদের নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। বাড়ছে নিয়মিত মদ ও জুয়ার আসর। বিভিন্ন হোটেলে ‘ডান্সবার’, ঢালাও মদ বিক্রির লাইসেন্স শহরের সাধারন মানুষকে নেশায় আসক্ত করে তুলেছে। করলা ও তিস্তা নদীর ‘স্পার’ এলাকা মাদকাসক্তদের দখলে চলে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই শহরে বাড়ছে শান্তিপ্রিয় মানুষের অনিশ্চয়তা ও উদ্বিগ্নতা এবং নিরাপত্তাহীনতা।

শহরের কলেজগুলিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষার মান তলানিতে প্রাইভেট টিউশনের রমরমা বাজার। ‘স্বাস্থ্য ও শিক্ষা’ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির মধ্যে অন্যতম। জেলা হাসপাতাল থাকলেও পর্যাপ্ত শয্যার সমস্যার আজও রয়ে গিয়েছে। ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট, ডায়ালাইজার, সিটিস্ক্যান প্রভৃতি পরিষেবার ব্যবস্থা থাকলেও, পর্যাপ্ত নয়। অভাব রয়েছে দক্ষ চিকিৎসক এবং টেকনিশিয়ানের। জেলাবাসীর কাছে ‘ন্যায্য মূল্যে ওষুধের’এর ব্যবস্থা যথেষ্ট আনন্দের। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও ঢেলে সাজাবার প্রয়োজন রয়েছে।

তবে একটা বড় প্রাপ্তি অবশ্যই জলপাইগুড়ির ‘স্পোর্টস ভিলেজ’। ক্রীড়ার মান উন্নয়নে এর অবদান অনস্বীকার্য। জেলার ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের কাছে এটি বড় পাওয়া। শহরের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বাথেই এই প্রতিবেদেনে গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যে দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি নাগরিক ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

রাজা রাউত, জলপাইগুড়ি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement