ঐতিহ্যের বিলিয়ার্ডস রুমের এখন এই দশা।—নিজস্ব চিত্র।
সময়টা উনিশ শতকের শেষ ভাগ। জলপাইগুড়ি জেলার পত্তনের পর ২০ বছর অতিক্রান্ত। ধীরে ধীরে বাড়ছে শহরের জনসংখ্যা। প্রশাসনের উচ্চপদে আসীন ইংরেজরা। শুধু কি তাই? চা বাগানের মালিক থেকে ম্যানেজার সবাই ইংরেজ। কিন্তু তাঁদের কোনও মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা ছিল না।
আর সেই কারণেই নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য আস্ত একটা ক্লাব তৈরি করে ফেলল বৃটিশ প্রভুর। গঠিত হল জলপাইগুড়ির প্রথম ক্লাব ‘জলপাইগুড়ি ক্লাব’। ইউরোপিয়ান ক্লাব নামেও এর পরিচিতি ছিল। ইংরেজরা ১০০ টাকা মূল্যের ৭৫০টি শেয়ার বাজারে ছেড়ে ক্লাব তৈরির প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় হয়েছিল। ১৮৯৪ সালে কোম্পানি আইনে নথিভুক্ত হয়। উনিশ শতকের শেষভাগে ১১ একর জায়গার মধ্যে ‘ক্লাব বিল্ডিং’ তৈরি হয়ে যায়।
দোতলায় পাঁচটি থাকার ঘর, একতলায় একটি বার, দু’টি হল, একটি বিলিয়ার্ড খেলার ঘর এবং একটি পাঠাগার গঠন করা হয়। ক্লাবের মাঠে চারটি টেনিস কোর্ট তৈরি করা হয়। জলপাইগুড়ি ক্লাবটি ইংরেজদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে তাঁরা নৌকোয় তিস্তা পেরিয়ে ছুটে আসতেন। জলপাইগুড়ির গবেষক উমেশ শর্মা বলেন, “একটাই আপত্তিজনক বিষয় ছিল। ক্লাবের সামনে লেখা থাকত ‘ডগস অ্যান্ড নেটিভস আর নট এ্যালাউড টু এন্টার ইনটু দ্য ক্লাব’। আর সে জন্যই সাধারণ মানুষের কাছে ক্লাবটি সমাদর পায়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্থানীয় চা-কররা ক্লাবে আধিপত্য বিস্তার করেন। এখনও ক্লাবের পরিচালক মণ্ডলীর পাঁচ সদস্যের মধ্যে দুজন চা-কর, একজন প্রাক্তন চা-কর, একজন ঠিকাদার এবং একজন আইনজীবী আছেন। ইংরেজরা চলে যাওয়ার ৬৮ বছর পরে এখন ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ৮৪ জন। তাঁরা সকলেই স্থানীয়। তাঁদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রতিদিন সন্ধ্যায় ক্লাবের বারে যান। একমাত্র সেটিই সচল রয়েছে। বাদবাকি ভবনের অবস্থা জরাজীর্ণ।
উপরের পাঁচটি থাকার ঘর তালাবন্ধ। ব্যবহারের অভাবে ঘরগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিলিয়ার্ড টেবিলটি ধুলোয় আচ্ছন্ন। পাঠাগারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত। স্বাধীনতার পর ক্লাবের লিজ নবীকরণ না করায় সরকার থেকে তার সাড়ে আট একর জায়গা নিয়ে নেওয়া হয়েছে। পারলে আরও জায়গা নিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত চলছে বলে মনে করেন ক্লাবের পরিচালক মণ্ডলীর সদস্যরা।
জলপাইগুড়ি ক্লাবের এ হেন অবস্থা দেখে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ জলপাইগুড়ির একসময়ের বাসিন্দা এবং কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার। তিনি এই অবক্ষয়ের জন্য বর্তমান পরিচালক মণ্ডলীর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারকেও দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “জলপাইগুড়ির এই প্রাচীন ক্লাবটির অবক্ষয়ের জন্য দায়ী বর্তমান পরিচালকমণ্ডলী। তাঁদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্লাবটির উন্নয়নের জন্য কিছুই করতে পারেননি। কলকাতায় একইভাবে তৈরি হয়েছিল যেমন ক্যালকাটা ক্লাব, টলি ক্লাব। এই ক্লাবগুলি আগের মতন একইভাবে চলছে। অথচ জলপাইগুড়ি ক্লাবের মত ক্লাবগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাজ্য সরকারেরও পর্যটনকে তুলে ধরার জন্য বিশেষ অনুদান দিয়ে এই ক্লাবটির উন্নতি ঘটানো উচিত।
জলপাইগুড়ি ক্লাবের বর্তমান পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য পীযূষকান্তি রাউথ ১৯৬০ সাল থেকে জলপাইগুড়ি ক্লাবের সদস্য। তিনি অরূপজ্যোতি মজুমদারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত না। তিনি বলেন, “আগে চা বাগানের ম্যানেজাররা জলপাইগুড়িতে এসে এই ক্লাবে থাকতেন। সরকারি আধিকারিকরাও থাকতেন। নানা পার্টি হত। চা বাগানের এজেন্সি হাউসগুলোর অনুদান ছিল। ক্লাবের আয় ছিল। এখন সেই আয় নেই। কলকাতার ক্লাবগুলির সঙ্গে তুলনা করা ভুল। কলকাতার ক্লাবগুলোতে এখনও কর্পোরেট হাউসের আধিপত্য আছে। ক্লাবের আয়ের পথ বন্ধ হয়নি।”
(চলবে)