কালী অর্চনায় মজে বাঙালি কালো মেয়ে সেই তিমিরেই

দুর্গতিনাশিনীর আরাধনার পরে আলোর মালায় সাজা শহরের দিকে চেয়ে এমন অনুভূতিমালায় বয়ে যায় শিরায় শিরায়। শরতের মেঘের মতো কত কথাই অনবরত ভেসে বেড়ায়।

Advertisement

সেবন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৭ ০৭:৪০
Share:

শিশিরের ছোঁয়ায় ভিজে যাচ্ছে ভোরের ঘাস। রং বদলের জন্য তৈরি হচ্ছে গাছেরা। পাহাড় কিংবা ডুয়ার্সের অরণ্যে কিছু দিনের মধ্যেই পাতা হলুদ হতে শুরু করবে। কোথাও কী সুন্দর কমলা রঙের হয়ে যাবে! দুর্গতিনাশিনীর আরাধনার পরে আলোর মালায় সাজা শহরের দিকে চেয়ে এমন অনুভূতিমালায় বয়ে যায় শিরায় শিরায়। শরতের মেঘের মতো কত কথাই অনবরত ভেসে বেড়ায়।

Advertisement

কিন্তু, বাস্তব বড়ই সোজাসাপ্টা। সেখানে গভীর রাতের দেবী আরাধনা পর্বেও নাছোড় বর্ষা, মশার কামড়, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, অজানা জ্বরের আনাগোনা। অনিবারণীয় পতঙ্গবাহিত অসুখে চতুর্দিকের রাজনৈতিক তরজায় দেবীকূলই একমাত্র ভরসা আমাদের!

ছোটবেলা মনে পড়ে। কালীপুজোর দিন আমাদের বাড়ির লক্ষ্মীপুজোর দিন। দার্জিলিং থেকে বড়জেঠু ঝুড়ি ভর্তি হলুদ গাঁদা ফুলের মালা নিয়ে আসতেন। কার্শিয়াং থেকে দিদি, দাদা-সহ সকলে উপস্থিত। ঠাকুমার শাশুড়ির একটা খুলে আসা ছিন্ন শাড়ির উপর ঠাকুমার সুতোর কাজের বেনারসি, তার উপর মায়ের বিয়ের বেনারসি পরিয়ে লজ্জাশীলা কলাবউকে লক্ষ্মীজ্ঞানে পুজো করা হতো। জানলায় চোখ পেতে সেই পুজোর আমেজ অনেক রাত অবধি জাগিয়ে রাখত আমাদের। কি উত্তেজনাময় সেই জাগরণ! অন্ধকার চেপে আসা কাঁটাতারহীন বাঘাযতীন পার্কে কালীপুজো শুরু হতো। জানলায় চোখ পেতে সেই পুজোর আমেজ রাত অবধি জাগিয়ে রাখত আমাদের। অনেক রাতের পুজো বলে ছোটদের বাইরে যাওয়া হতো না। জানলার ফাঁক দিয়ে মন্ত্রধ্বনি শোনা যেত। মাইকবিহীন কাঁসর ঘণ্টা বাজত। পরদিন ঠাকুর দেখতে বেরোনো। বাড়ির পিছনে একবার আকাশচুম্বি কালীমূর্তি দেখেছিলাম।

Advertisement

কালী শক্তিদেবীর দশ প্রধান রূপভেদের প্রথম। কালীর শান্ত ও উগ্র রূপের বর্ণনা বিভিন্ন পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়। বিষ্ণু ধর্মোত্তরে বর্ণিত ভদ্রকালীর রূপ সুন্দর ও শান্ত। মার্কন্ডেয় পুরাণ অন্তর্গত দেবীপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে কালী বা ভদ্রকালী উগ্ররূপা। বাংলায় কালীর নিয়মিত উপাসকের সংখ্যা ও হাটেঘাটে মাঠে পথকোণে, ইনি স্থানীয় নানা নামে ও বিষয় অনুযায়ী পূজিতা। যেমন, শ্মশানকালী, যশোরেশ্বরী, ঢাকেশ্বরী, আনন্দময়ী, সিদ্ধেশ্বরী ইত্যাদি। কালীনাচ বা কালীর বেশে নাচ প্রধানত মুখোশ ধারণ করেই হয়। স্বভাবতই এ সব নৃত্য-সহ যে কালীর আরাধনা করে থাকি, তাতে রৌদ্র ভয়ানক ও বীভৎস রসেরই প্রাধান্য। নেপালেও মহাকালী মুখোশ নৃত্যের প্রচলন আছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, রূপে অনার্যা শাক্ত এই দেবীর শিকড় সমাজ সংস্কারে এখনও দৃঢ় প্রোথিত।

নীলবর্ণ কৃষ্ণ ছাড়া এমন ঘোর কৃষ্ণা দেবী কই? গৌরচম্পকবর্ণা, বাঘ বা সিংহবাহিনী দেবীর পাশে করালবদনা মুণ্ডমালাধারী ডাকিনী যোগিনী পরিবৃতা ও শ্মশানচারী প্রাণী পরিবেষ্টিত এমন দেবীর উপাসনা ব্যতিক্রম বললেই চলে। ইনি সর্বার্থে পৃথক। স্বামী মহাদেব মাথার পাশে বা উপরে নন, একেবারে পদতলে শয়ান। দেবীর জিব লজ্জায় লাজুক হলেও রক্তাভ। হাতে ধরা কর্তিত মুণ্ড থেকে রক্তবিন্দু ঝরে পরে শ্মশানভূমে। জল বা গোলাপি রঙা পদ্ম নয়, রক্তজবার মালাই তাঁর আরাধনার পুষ্প। হাড়হিম করা সত্যি গল্পের ডাকাত দল তাঁর মন্দিরের সামনে হাড়িকাঠে চতুষ্পদ মাত্র নয়, স্বজাতি বলি দিয়ে কার্যসিদ্ধিতে যেত। আবার দেশমাতৃকার জন্য নিবেদিত প্রাণ স্বদেশি ডাকাত বা বিপ্লবী দল শপথ নিত তাঁরই রাঙা পায়ে।

উত্তরের নানা গল্পগাছায় থাকা এমন উপন্যাসের চরিত্রের কালীমন্দির আছে শিকারপুরে। প্যাগোড়া ধরনের কালীমন্দিরে চৈনিক প্রবাদের গল্পও আছে। এটি হল দেবী চৌধুরানির মন্দির ও ভাবানী পাঠকের কালীবাড়ি। মাসকলাইবাড়ির শ্মশানেও দেবী চৌধুরানির মন্দির কালীমন্দির আছে।

অমঙ্গলকে দূরে রাখা ও শান্তির আবাহন যে কোনও পুজোর মূল মন্ত্র। পারস্পরিক মিলন ও উৎসব তার সামাজিক রূপ। তার উপর এত কারিগর চিত্রকর মৃৎশিল্পী ডেকরেটর আলোকশিল্পী, ফল-ফুল বিক্রেতা শ্রমিক পুজোয় জড়িয়ে থাকেন যা অর্থনীতির চাকাটি সচল রাখে।

যাঁর অর্চনায় হিন্দু বাঙালি এমন নিবেদিত প্রাণ, যে দেবীকে রামপ্রসাদি সুরে ঘরের বেড়া বাঁধতে বলা যায় অনায়াসে, ফিরিঙ্গি অ্যান্টনিকে মজিয়ে রাখে গভীর কালো রূপে, তাঁকে কেন শুধু ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বেঁধে রাখে বাঙালি? কেন এখনও পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে শুধু ফর্সা মেয়ের আবাহন? কেন এখনও বাস্তবের কালো মেয়ের কোনও ঠাঁই নেই শ্রদ্ধার জগতে? কেন ক্ষীণ কটিবাসের শ্মশানচারী দেবী শুধু ভাবজগতেই শ্রদ্ধা লাভ করবেন, যেখানে মেয়েদের প্রতিনিয়ত পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে নানা নিষেধের জাঁতাকলে বন্দি রাখতে চাই?

আর যাই হোক, মণ্ডপে বেজায় ভক্তির পেন্নাম ঠুকে, প্যান্ডেল হপিং করে এসে বিয়ের সময়ে গমরঙা কন্যার জন্য হাহাকার করলে, পণের জন্য বউ পোড়ালে, কালো মেয়ে পার করার দুশ্চিন্তায় গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললে দেবী সন্তুষ্ট হবেন না! যতই দেবী হোন, স্বজাতির অপমানে, লজ্জায় তিনি আরও একবার জিভ কাটবেন না, কে বলতে পারে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement